Ami Tarashis Bolchi

Ami Tarashis Bolchi
The blog of Tarashis Gangopadhyay (click the photo to reach our website)

Saturday, 16 August 2025

ক্রিয়া যোগ - নীরব আলোর দিশায়। - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। অধ্যায় ১ - নীরব পর্বতের কোলে

ক্রিয়া যোগ — নীরব আলোর দিশায়

অধ্যায় ১ — নীরব পর্বতের কোলে

পাহাড়ের উপরের ওই আশ্রমের চাতালের দিকে ওঠা পাথুরে পথটি বেঁকে গেছে গভীর শালবনের মধ্য দিয়ে। ভোরের আগে-পরে হালকা ঠান্ডা হাওয়া পাতাগুলোকে মৃদুস্বরে দোলাচ্ছে — যেন শালবনের ভিতরে কোন অজানা ঋষি  কোনো গোপন মন্ত্র জপকরে চলেছেন। পাহাড়ের গায়ে সাদা কুয়াশা নরম চাদরের মতো ঝুলে আছে। অনেক নিচে, গঙ্গা স্রোতের গভীর স্বরে গুনগুন করছে—যেন অদৃশ্য কোনো ঋষি অনন্তকাল ধরে স্তোত্রপাঠ করছেন।

দূরের হিমালয়ের তুষারশৃঙ্গগুলো তখনও ছায়ার ভেতর ঢাকা, কিন্তু প্রথম সূর্যালোকের ক্ষীণ আভা তাদের কপালে ছুঁয়ে গেছে—যেন সূর্য নিজেও আজ এই মহাশান্ত পাহাড়গুলিকে প্রণাম করছে।

অরুণ ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙছিল। পাথরের খসখসে ধাপগুলির উপর দিয়ে যাবার সময় পায়ের নীচে বেশ ঠান্ডা লাগছিল। প্রতিটি পদক্ষেপের শব্দ মিলেমিশে যাচ্ছিল দূরের মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি আর গঙ্গার গম্ভীর স্রোতের সঙ্গে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্রিয়া যোগ নিয়ে তার মনে নানা প্রশ্ন জেগেছিল। সেই প্রশ্নগুলো যেন অস্থির পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছিল ভেতরে। আজতাই সে ঠিক করেছে - এই ভোরে, গুরুজীর সামনে বসে সে উত্তর চাইবে।

চূড়ায় পৌঁছেই চোখে পড়ল ধ্যানকক্ষ—খোদাই করা কাঠের দরজা আধখোলা, ভেতর থেকে ভেসে আসছে চন্দনধূপের মিষ্টি গন্ধ। ভিতরে নীরবতা ঘন হয়ে আছে, যেন সময়ও থমকে গেছে। মেঝেতে বিছানো জীর্ণ কার্পেট বহু বছরের ধ্যানের স্পর্শে নরম হয়ে গেছে।

দূরের পূর্বমুখী জানলার নিচে গুরুজী বসে আছেন—পিঠ একদম সোজা, হাত আলতোভাবে কোলে রাখা, চোখ বন্ধ। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম এক হাসি—যেন তিনি জানেন বাইরে হাওয়ার শব্দ, নিচের নদীর গুঞ্জন, আর এই মুহূর্তে দোরগোড়ায় নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর শিষ্যের মনের সব কথা।

অরুণ নত হয়ে প্রণাম করল, কপাল ঠেকাল মাদুরে, “গুরুজী,” সে আস্তে বলল, “আমি এসেছি… ক্রিয়া সম্পর্কে কিছু জানার জন্য।”

গুরুজী ধীরে চোখ খুললেন—দুটি চোখ যেন গভীর হ্রদের শান্ত জলে আকাশের অসীমতা ধরা পড়েছে, “বসো, বৎস,” গুরুজীর কণ্ঠ উষ্ণ অথচ দৃঢ়, “প্রশ্ন হল সাধকের লক্ষ্যের দিকে ফেলা প্রথম আন্তরিক
পদক্ষেপ। সৎ হৃদয় থেকে উৎসারিত প্রশ্ন একদিন তোমাকে সত্যের হৃদয়ে পৌঁছে দেবে।”

অরুণ পদ্মাসনে বসল। মেরুদণ্ড অনায়াসে সোজা হয়ে গেল। উত্তেজনায় শ্বাস দ্রুত হচ্ছিল। সে বলল, “গুরুজী,” সে বলল, “বইয়ে দেখি চক্রগুলিকে নানা রঙে, পাপড়িতে, সংস্কৃত বর্ণে সাজানো হয়… কিন্তু ক্রিয়ায় আমি কীভাবে তাদের চিনব?”

গুরুজীর মুখে হালকা হাসি ফুটল, “ক্রিয়ায় আমরা মনের দেওয়ালে ছবি আঁকতে সময় নষ্ট করি না। চক্র কোনো কল্পনার ছবি নয়—এরা হল জীবন্ত কেন্দ্র, তোমার সূক্ষ্ম মেরুদণ্ডের ভিতরে স্থাপন করা। এগুলি হল আত্মার দিকে ওঠার সিঁড়ির ধাপ। শুরুতে তুমি শুধু তাদের অবস্থান আন্দাজে অনুভব করবে। কিন্তু অনুশীলন যত গভীর হবে, উপলব্ধি ততই স্বচ্ছ হবে। রঙ-পাপড়ি কল্পনা করতে গিয়ে অনেকেই আসল প্রবাহ হারিয়ে ফেলে।”

অরুণ একটু দ্বিধায় বলল,
“তাহলে… তাদের সত্য রূপ আমি কীভাবে জানব?”

গুরুজীর কণ্ঠ আরও শান্ত হয়ে এল, “যখন মন নীরব হয়, দেহ শিথিল হয়, আর আত্মা অসীমের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়—শ্বাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভেতরে ফিরে আসে। তখন চক্রগুলির নিজস্ব আলো, ধ্বনি, স্পন্দন ধরা দেয়। কেচরী মুদ্রা, যখন প্রাণবায়ু স্তব্ধ হয়ে যায়, সেই উপলব্ধিকে আরও গভীর করে তোলে।”

তিনি যেন বাতাসে অক্ষরে অক্ষরে মন্ত্র খোদাই করছিলেন, “প্রতিটি চক্রের দুটি দিক আছে—ভিতরের দিকটি হল আলোর কম্পন, যা চেতনাকে ওপরে তোলে। বাইরের দিকটি হল সেই জীবনশক্তি যা তোমার দেহকে পুষ্ট করে। চক্রের ভিতরের দিক অর্থাৎ তার মূল সত্তা হল এক সূক্ষ্ম আলোক-কম্পন, যা তোমার চেতনাকে টেনে নিয়ে যায় উপরের দিকে, আত্মার দিকে। চক্রের বাইরের দিক অর্থাৎ তার শারীরিক রূপ হল এক বিস্তৃত আলোকপ্রভা, যা তোমার দেহকে সঞ্জীবিত  রাখে।

ক্রিয়া প্রণায়ামের সময়, যখন তুমি মেরুদণ্ডের পথে ধাপে ধাপে ওপরে উঠছ, তখন মনে হবে - চক্রগুলো যেন ছোট ছোট তারার মতো ঝিলমিল করছে - যেন ফাঁপা নলের মত দেখতে আমাদের মেরুদণ্ডের  ভেতর  কেন্দ্রে জ্বলছে।

আবার, যখন তোমার সচেতনতা ধীরে ধীরে নীচে নামবে, তখন চক্রগুলো মনে হবে যেন শক্তি বিকিরণের দুয়ার— যেখান থেকে উপরের অসীম উৎস থেকে আসা শক্তি তোমার দেহে ছড়িয়ে পড়ছে।
প্রতিটি চক্র থেকে দীপ্তিময় রশ্মি বেরিয়ে এসে তার সামনের অংশে প্রাণপ্রবাহ জাগিয়ে তোলে।”

অরুণ চোখ বুজল। নিজের মেরুদণ্ডের মাঝে সেই আলোর ধাপ অনুভব করতে চেষ্টা করল। তারপর বলল, “গুরুজী… দয়া করে তাদের অবস্থান একে একে বলুন।”

গুরুজী  বললেন,
“মূলাধার—মেরুদণ্ডের গোড়ায়, লেজের হাড়ের বা tail bone এর ঠিক উপরে।
স্বাধিষ্ঠান—মূলাধার ও নাভির মাঝামাঝি।
মণিপুর—কোমরের কাছে, নাভির সমতলে।
চতুর্থ চক্র অনাহত—পিঠের মাঝ বরাবর হৃদয় চক্র রূপে এর অবস্থান। কাঁধের হাড় দুটো কাছে আনার সময় বা ঠিক নিচের টানটান পেশিতে মন দিলে টের পাবে। পঞ্চম চক্র হল বিশুদ্ধ—যেখানে গলা আর কাঁধ মিলেছে। মাথা আস্তে আস্তে দুই পাশে ঘোরালে, যে জায়গায় হালকা “কট কট” শব্দ শুনবে, সেখানেই এর আসন।

তবে ক্রিয়া প্রাণায়ামের অনুশীলনে তুমি শিখবে মেডুলা— অর্থাৎ মেরুদণ্ডের শীর্ষে থাকা সূক্ষ্ম কেন্দ্র—অনুভব করতে।
মেডুলায় মন স্থির করে ভ্রুমধ্য বা দুই ভ্রুর মাঝখান থেকে তুমি ভেতরের দৃষ্টি দাও— দেখবে সেখানে ক্ষীণ এক আলো জ্বলছে।

সেই আলোর স্থান থেকে প্রায় আট সেন্টিমিটার পেছনে গেলে পৌঁছবে ষষ্ঠ চক্র আজ্ঞায়।

এই আজ্ঞা চক্রকে বলা হয় আত্মার আসন। এই হল আধ্যাত্মিক জগতের দরজা। এখানে মন স্থির হলে, ভ্রুমধ্যের আলো বড় হতে হতে রূপ নেবে কূটস্থ বা আধ্যাত্মিক নয়নে—যেন অসীম আলোর গোলকের কেন্দ্রে এক দীপ্ত বিন্দু।

এই অভিজ্ঞতায় তুমি অনুভব করবে—পুরো বিশ্ব যেন তোমার নিজের দেহের মত। এটাই কূটস্থ চৈতন্য—যেখানে ভেতরের দরজা খুলে অসীমের সাথে মিলিত হওয়া যায়।

অরুণ আস্তে বলল, “তারপর?”

— “তারপরেও আছে। খেচড়ী মুদ্রায় জিভের ভেতর দিয়ে যে সূক্ষ্ম শক্তি প্রবাহিত হয়,তা মৃদু কম্পনে জাগিয়ে তোলে পিটুইটারি গ্রন্থিকে— মটরের দানার মতো ছোট্ট এই গ্রন্থি
মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের তলায় ঝুলে আছে। এটি হল
অদৃশ্য অথচ শক্তিধারার প্রবেশদ্বার। এটাই আজ্ঞা চক্রের শারীরিক প্রতিচ্ছবি,
যেন আত্মার জানালায় বাঁধানো একটি ক্ষুদ্র রত্ন।

এর ঠিক পেছনে, গভীর নীরবতায় লুকিয়ে আছে
পিনিয়াল গ্রন্থি - পাইনকোনের মতো আকার, প্রাচীন সাধকরা যার প্রতীক রেখেছেন মন্দির ও মূর্তির অলংকরণে। যখন এই কেন্দ্রে শ্বেত শুভ্র আধ্যাত্মিক জ্যোতি ফুটে উঠবে, তখন তুমি পৌঁছে যাবে সাধনার শিখরে— যেন সীমাহীন আকাশের মাঝে তোমার অন্তর হয়ে যাবে আলোর সূর্য।

কিন্তু রহস্য এখানেই শেষ নয়। স্বামী প্রণবানন্দ গিরি বলেছেন - মস্তিষ্কের ভেতরে আছে আরও দুটি গুপ্ত কেন্দ্র—রৌদ্রী ও বামা।
রৌদ্রী থাকে বাঁ দিকের আকাশে, বাঁ কানের উপরে। বামা ডান দিকের আকাশে, ডান কানের উপরে - যেন চেতনার দু’টি দরজা, যা খুলে দেয় উচ্চ ক্রিয়ার রাজপথে প্রবেশপথ।

যখন তুমি এই অঞ্চলগুলোতে ধ্যান করবে, মস্তিষ্ক রূপ নেবে দীপ্ত আলোর এক নগরীতে— প্রতিটি কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়বে সোনালি, নীল, আর শুভ্র রশ্মি, যা তোমাকে নিয়ে যাবে ক্রমশঃ উর্ধ্বে, অসীমের হৃদয়ের দিকে।”

দূরে গঙ্গার স্রোত যেন গুরুজীর বাক্যের প্রতিধ্বনি তুলল।

— “গুরুজী,” অরুণ বলল, “আমি এই যাত্রা শুরু করব কীভাবে বসে?”

— “পূর্বমুখী হয়ে বসো,” গুরুজী বললেন, “অর্ধপদ্মাসনে দেহ স্থির অথচ শিথিল রাখো। নিতম্ব সামান্য উঁচুতে রাখতে কুশন নিতে পারো—মেরুদণ্ড যেন দেবদারুর কাণ্ডের মতো সোজা হয়। ক্লান্ত হলে পা বদলাও। সিদ্ধাসন এক্ষেত্রে খুবই ভাল।এটি প্রাণের বৃত্ত সম্পূর্ণ করে। পূর্ণ পদ্মাসন আরো ভালো তবে সেটি কেবল তাঁদের জন্য, যাদের দেহ স্বাভাবিকভাবে মানিয়ে নিতে পারে এর সাথে। মনে রেখো—ভঙ্গির জটিলতায় নয়, মেরুদণ্ডের স্থিরতায় চক্রের দ্বার খোলে।”

অরুণ একটু সরে বসল। মেরুদণ্ডের সঠিক অবস্থান অনুভব করল, “আর হাত, গুরুজী?”

— “লাহিড়ী মহাশয়ের মত আঙুল জড়িয়ে ধরো—এতে শরীরের দুই পাশের প্রবাহ এক হয়। ক্রিয়ায় প্রাণায়াম ও ধ্যান অবিচ্ছিন্ন—যেন মোহনায় মুখোমুখি নদী আর সাগর।”

জানলা দিয়ে আলো এসে গুরুজীর মুখ সোনালি করে তুলল।

— “গুরুজী,” অরুণ ধীরে বলল, “যদি কিছু অনুভব না করি? যদি আলো বা কম্পন কিছুই না পাই—শুধু অন্ধকার যদি ভিড় করে আসে?”

গুরুজী সামান্য ঝুঁকে এলেন, “তাহলে সেই অন্ধকারকে প্রিয় বন্ধুর মত গ্রহণ কর। তাকে তাড়িয়ে দিও না। তার সঙ্গে শ্বাস নাও। একদিন তুমি বুঝবে—সে তো সবসময় আলো ছিল।”

বাইরে আবার মন্দিরের ঘণ্টা বেজে উঠল। সূর্য তুষারশৃঙ্গে উঠতে লাগল। সেই মুহূর্তে অরুণ অনুভব করল—অন্তরের বন্ধ কপাটগুলো ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে।
(ক্রমশ)

(যাঁরা পড়ছেন জানাবেন কেমন লাগছে। পাঠকদের অধিকাংশের ভালো লাগল তবেই দ্বিতীয় অধ্যায়ের লেখা শুরু করব।)

#ক্রিয়াযোগ #ক্রিয়াযোগবাংলা #বাংলাযোগ #ধ্যানযোগ #ধ্যানওসাধনা 
#প্রাণায়াম #আধ্যাত্মিকযাত্রা #অন্তরযাত্রা #আত্মসাধনা #গুরুশিষ্য 
#যোগেরগোপনবিদ্যা #সত্যঅন্বেষণ #শান্তিরপথ #আত্মজ্ঞান #যোগবাংলায়
#ক্রিয়াযোগ 
#বাংলাযোগ 
#ধ্যানওসাধনা 
#অন্তরযাত্রা 
#প্রাণায়াম 
#আত্মসাধনা 
#ধ্যানমার্গ 
#যোগেরগোপনবিদ্যা 
#আধ্যাত্মিকযাত্রা 
#শান্তিরপথ 
#ধ্যানযোগ 
#গুরুশিষ্য 
#সত্যঅন্বেষণ 
#আত্মজ্ঞান 
#যোগবাংলায়

ক্রিয়াযোগ – নীরব আলোর পথ। তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। অধ্যায় দুই : জিভের দ্বার


ভোরের প্রথম আলো নরম ভঙ্গিতে হিমালয়ের চূড়া ছুঁয়ে নামল, যেন সোনালী কিরণের জোয়ার গড়িয়ে পড়ল উপত্যকায়। উত্তরকাশী তখন জেগে উঠছিল, তবুও আশ্রমের ভেতর নিস্তব্ধতা এত গভীর ছিল যে ধ্যানমন্দিরের খোলা জানলা দিয়ে দূরবর্তী গঙ্গার ক্ষীণ গুঞ্জনও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। গঙ্গার স্রোতে দূরে  রুপালী ঝিলিক  দেখা যাচ্ছিল—চঞ্চল, প্রাণবন্ত, যেন খাপছাড়া এক তরবারি।

অরুণ শান্তভাবে বসে ছিল আশ্রমের হলের ঠান্ডা তক্তপোশের ওপর, হাঁটুর উপর হাত রেখে। এই অতল নীরবতায় সে এখনো পুরোপুরি অভ্যস্ত নয়। বাতাসে চন্দনের হালকা ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছিল, সাথে পাহাড়ি হাওয়ার শীতল নিশ্বাস।

তার সামনে গুরুজী একটি নীচু আসনে বসেছিলেন পদ্মাসনে, অবলীলায় সোজা হয়ে। তাঁর দেহটি যেন এক অতি প্রাচীন দেবদারু—অচঞ্চল, অথচ জীবন্ত। চোখ অর্ধেক বুঁজে, তবু অরুণ অনুভব করল—চোখ না খুলেও গুরুজী তাকে যেন অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে গভীরভাবে দেখছেন। 

দীর্ঘক্ষণ কারো মুখে কোনো শব্দ উঠল না। শেষমেশ নীরবতা ভেঙে অরুণ বলল, “গুরুজী, গতকাল আপনি চক্র আর মেরুদণ্ডের  মানচিত্র নিয়ে বলেছিলেন। কিন্তু আপনি কৌশলগুলোর কথাও বলেছিলেন—এই অন্তঃপথে চলার অনুশীলন। বলেছিলেন সাধনা করতে হলে এই ক্রিয়া দিয়ে শুরু করতে হয়। আজ কি আপনি আমাকে এটি শেখাবেন?”

গুরুজী ধীরে ধীরে চোখ তুলে চাইলেন। তাঁর শান্ত অথচ গভীর দৃষ্টি যেন অরুণকে ভেদ করে গেল। “হ্যাঁ,” তিনি বললেন। “ ক্রিয়ার পথ শুরু হয় আটটি মৌলিক কৌশল দিয়ে। তার প্রথমটিই হলো তালব্য ক্রিয়া। এটি জিভকে প্রস্তুত করে খেচরী মুদ্রার জন্য। আর খেচরী মুদ্রাই খুলে দেয় ঊর্ধ্বস্রোতের দ্বার।”
 
অরুণ সাগ্রহে চেয়ে থাকে। 

“ভালো করে শোনো,” গুরুজী বললেন, “অনেক সাধক তাড়াহুড়ো করে শ্বাসসাধনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু প্রাচীন গুরুরা জানতেন—জিভকে প্রস্তুত না করে দিলে মেরুদণ্ড আর মস্তিষ্কের মধ্যে যে স্রোতপথ আছে, সেটি সম্পূর্ণ হয় না।”

অরুণ অজান্তেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল, “তাহলে আমাকে কী করতে হবে, গুরুজী?”


গুরুজি বললেন,
“প্রথমে জিভ শিথিল রাখো। জিভের আগা হালকা করে রাখো উপরের দাঁতের গোড়ায়।। ডগাটা উপরের দাঁতের পেছনে হালকা ঠেকিয়ে দাও—পেছনে ভাঁজ কোরো না, জোরে তুলো না। তারপর জিভের মূল অংশ উপরের তালুতে চেপে ধরো, যেন একপ্রকার শূন্যতা বা সাকশন তৈরি হয়। ডগাটা থাকবে সামনের দাঁতের গায়ে। এরপর নীচের চোয়াল ধীরে ধীরে নামাও—তখন একটা টান অনুভব করবে।”

তিনি নিজের চিবুকের নীচে আঙুল রাখলেন—সেখানে টান ধরার ইঙ্গিত দিলেন। অরুণও অনুভব করল—মৃদু টান, তারপর ক্রমে হালকা ব্যথার মতো এক টান ফুঁটে উঠল।

অরুণ চেষ্টা করল, কিন্তু হঠাৎই তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। গুরুজির চোখ তীক্ষ্ণ হলো।

“ওভাবে নয়,” তিনি বললেন। “অনেকে স্বভাবতই জিভ উল্টে দেয় বা একেবারে খাড়া রাখে—তাতে কাজ হয় না। আগা রাখো সামনের দিকে, শরীর চাপ দাও ওপরের দিকে। এবার নিচের চোয়াল আস্তে নামাও, suction ধরে রেখে। টানটা টের পাবে এখানে।”

তিনি আঙুল দিয়ে দেখালেন থুতনির নিচের নরম অংশে। অরুণ সেখানে প্রথমে মৃদু টান অনুভব করল, তারপর ধীরে ধীরে ব্যথার মতো এক টান জেগে উঠল।

“এখন suction ছেড়ে দাও, যেন একটা ক্লিক শব্দ হয়,” গুরুজি নির্দেশ দিলেন। “তারপর জিভ বাড়িয়ে দাও বাইরে, চিবুকের দিকে নামিয়ে দাও। দিনে দশবারের বেশি করবে না শুরুতে। শরীরকে কষ্ট দিয়ে নয়, ধীরে ধীরে প্রস্তুত করে এগোতে হয়। কয়েক মাস পরে তুমি পঞ্চাশ বারও করতে পারবে। তখন সময় লাগবে দুই মিনিট।”

বাইরে গঙ্গার স্রোত যেন মিলিয়ে গেল অরুণের অনুশীলনের ছন্দে—চাপ, টান, ক্লিক, প্রসার।

“কিন্তু গুরুজি,” অরুণ একটু দ্বিধায় বলল, “মাসের পর মাস পরে কী হয়?”

গুরুজির চোখ যেন তার সীমার বাইরে কোথাও চাইল, অদৃশ্য কোনো মন্দিরের দিকে।
“একদিন, কোনো কষ্ট ছাড়াই, জিভ নিজে থেকেই সরে যাবে তালুর পেছনের গহ্বরে। তখন খেচরী হবে সহজসাধ্য। তখন নিঃশ্বাস প্রায় মিলিয়ে যাবে; মন ভেতরে ফিরে যাবে; আর স্রোত বইবে এমনভাবে—যা ভাষায় ধরা যায় না।”

অরুণ জিজ্ঞাসা করল,
“এটা কি সত্যিই এত প্রয়োজনীয়, গুরুজি? এত ছোট জিনিস, অথচ লক্ষ্য এত বিরাট…”

গুরুজি হেসে উঠলেন মৃদু স্বরে।
“অনন্তের দরজা প্রায়ই লুকিয়ে থাকে ক্ষুদ্রতম গতিতে। তালব্য ক্রিয়া কোনো ব্যায়াম নয়—এটা সেই চাবি, যেটি একদিন তোমার চেতনা খুলে দেবে মাথার উপরে অবস্থিত সহস্রার-এর আকাশে।”

অরুণের মনে ছবি গেঁথে গেল—যেন এক ফোঁটা জাফরান দুধের বাটিতে মিশে রঙ ছড়িয়ে দিল। ঘরের নীরবতা আরও ঘনীভূত হল।

কিছুক্ষণ পরে অরুণ আস্তে বলল,
“গুরুজি, গতকাল আপনি চক্রের পথের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তখনও বলেছিলেন কৌশলের কথা। তাহলে কি এখন শুরু করবেন?”

গুরুজি মাথা নাড়লেন ধীরে।
“নদীকে আগে পাথর থেকে মুক্ত করতে হয়, তারপরই সে সমুদ্রের দিকে সোজা বয়ে যেতে পারে। তালব্য ক্রিয়া হলো সেই প্রথম ধাপ। দেখতে সহজ, অদ্ভুতও লাগতে পারে, কিন্তু এর মাধ্যমেই তোমার যাত্রা শুরু হবে—খেচরী মুদ্রা আর তারও অনেক দূরে।”

অরুণ ভ্রু কুঁচকালো,
“কিন্তু গুরুজি, কেন জিভ দিয়ে এই প্রক্রিয়ার শুরু?"

গুরুজি উত্তর দিলেন শান্ত ভঙ্গিতে,
“ক্রিয়ায় জিভই হলো সেতু। ওকে না প্রস্তুত করলে মেরুদণ্ড আর মস্তিষ্কের মধ্যে যোগ হয় না। এমনকি খেচরী আয়ত্তের পরও তালব্য চালিয়ে যেতে হয়। এতে মন একেবারে স্থির হয়—কেন হয়, কেউ বলতে পারে না। তুমি নিজেই একদিন বুঝতে পারবে।”

তিনি ইশারা করলেন অরুণের মুখের দিকে।
“বসো আরাম করে। জিভের আগা রাখো উপরের দাঁতের গোড়ায়। উল্টাবে না, খাড়া করবে না। আগা থাকুক সেখানেই, বাকিটা চাপ দাও তালুর সঙ্গে। এবার চোয়াল নামাও আস্তে করে, আর টানটা অনুভব করো নিচে।”

অরুণ সেভাবেই করল। আবারও সেই টান, সেই ব্যথা।

“ভালো,” গুরুজি বললেন। “এখন ক্লিক করে ছেড়ে দাও, তারপর জিভ বাড়িয়ে চিবুকের দিকে নামাও। দিনে দশবারের বেশি নয়। কয়েক মাস পর তুমি পঞ্চাশে পৌঁছাবে। তখন শরীর প্রস্তুত হলে জিভ নিজেই ঢুকে যাবে তালুর পেছনের গহ্বরে। সেটাই খেচরী।”

অরুণ একটু ইতস্তত করল।
“গুরুজি, হঠযোগের বইতে পড়েছি কাপড় দিয়ে টেনে জিভ লম্বা করার কথা। সেটা কি দরকার?”

গুরুজির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো, কিন্তু স্নেহভরা, “কেউ কেউ করে থাকে। কিন্তু লাহিড়ী মহাশয় নিজে এর বিরোধিতা করেছিলেন—কোনো কেটে বা আঘাত দিয়ে দ্রুত ফল আনতে নেই। কাপড় দিয়ে টানার প্রক্রিয়া করা যায়, তবে খুব কোমলভাবে, আঘাত ছাড়াই। চাইলে আঙুল দিয়ে জিভ আর নিচের পেশিতে মালিশ করতে পারো। কিন্তু মনে রেখো—ধৈর্যই ক্রিয়ার সত্যিকারের ধারক।”

তারপর তিনি সামান্য ঝুঁকে বললেন, “আর মনে রেখো—তালব্য ক্রিয়া আর খেচরী মুদ্রা এক নয়। আয়নার সামনে করলে দেখবে জিভের নিচে দু’পাশে ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়, যা জিভের মূল দেহ থেকে আলাদা। কিন্তু খেচরীতে uvula এগিয়ে আসে, আর কেবল জিভের গোড়া দেখা যায়। এই দুইটি পথ তাই ঘনিষ্ঠ হলে পৃথক।”

অরুণ আবার করল চাপ, টান, ক্লিক, প্রসার—চোয়াল ইতিমধ্যেই ভারী লাগছে। সে জিজ্ঞেস করল,
“গুরুজি, এই প্রথম কৌশল… কি শ্বাসসাধনার সঙ্গে সম্পর্কিত?”

গুরুজি হেসে উঠলেন, “সংক্ষিপ্ত শ্বাসের যে প্রাণায়াম আছে, তাকে ক্রিয়া প্রণায়ামেরই একটি রূপ বলা যায়। বিশেষ কিছু কারণে সেটাকে আগেভাগে শেখানোও হতে পারে। কিন্তু সেটা পরের অধ্যায়ের কথা।”

বাইরে গঙ্গার স্রোত ধ্বনি উঠছিল মৃদু, যেন অন্তহীন এক স্তোত্র।

গুরুজি বললেন,
“একদিন তুমি দেখবে—এই ছোট্ট ক্রিয়া করতে গিয়েই তোমার মনের কোলাহল থেমে যাবে। যেমন গঙ্গা প্রবাহিত হয় নিঃশব্দে তার ঢেউয়ের কোলাহলের নিচে, তেমনি তোমার চেতনাও বইবে একই ভাবে যখন অন্তঃস্রোত মুক্তি পাবে।”

অরুণ গুরুজীকে প্রণাম করল। মুখে ব্যথার টানটা তখন আর যন্ত্রণার মতো লাগছিল না, বরং এক দীক্ষার চিহ্নের মতো। বাইরে নদী মৃদু কল্লোলে পাহাড়কে গল্প শোনাচ্ছিল। অরুণ নিজের ভেতরেও অনুভব করল সেখান থেকেও কিছু একটা মৃদু কল্লোলের শব্দ যেন ভেসে আসছে।
ক্রমশ 


#ক্রিয়াযোগ #ক্রিয়াযোগবাংলা #বাংলাযোগ #ধ্যানযোগ #ধ্যানওসাধনা 
#প্রাণায়াম #আধ্যাত্মিকযাত্রা #অন্তরযাত্রা #আত্মসাধনা #গুরুশিষ্য 
#যোগেরগোপনবিদ্যা #সত্যঅন্বেষণ #শান্তিরপথ #আত্মজ্ঞান #যোগবাংলায়
#ক্রিয়াযোগ 
#বাংলাযোগ 
#ধ্যানওসাধনা 
#অন্তরযাত্রা 
#প্রাণায়াম 
#আত্মসাধনা 
#ধ্যানমার্গ 
#যোগেরগোপনবিদ্যা 
#আধ্যাত্মিকযাত্রা 
#শান্তিরপথ 
#ধ্যানযোগ 
#গুরুশিষ্য 
#সত্যঅন্বেষণ 
#আত্মজ্ঞান 
#যোগবাংলায়

Friday, 15 August 2025

ভোজ যখন অভিশাপ - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়



গ্রামের নাম সূর্যপুর। নদীর ধারে সবুজে ঘেরা ছোট্ট সেই গ্রামে সবাই শান্তিতে থাকত। তবে সেই শান্তি বেশীরভাগ লোক অনুভব করত যখন তাদের প্রতিবেশীর কিছু ক্ষতি হত। আসলে মানুষে-মানুষে ঈর্ষা যে এক চিরন্তন ব্যাপার।

 অর্ক ছিল সেই গ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় যুবক। পরিশ্রমী, সহৃদয়, আর সবার কাছে প্রিয়।
কিন্তু সবার কাছে সে প্রিয় হয়ে ওঠায় কিছু মানুষের মনে হিংসার মেঘ জমে উঠেছিল তার প্রতি। বিশেষত, গ্রামের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী রতন মন্ডলের। রতন চাইত না যে কেউ তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হোক। তাই বাইরে থেকে সে হাসিমুখে অর্ককে ভাই বললেও, ভেতরে ভেতরে চাইত তার সর্বনাশ।

এক বছর শরৎ উৎসবে রতনের বাড়িতে মহাভোজের আয়োজন হলো। গ্রামে ঢাকঢোল বাজল—রতনের বাড়ি থেকে গ্রামের সবাইকে জানানো হল আমন্ত্রণ। অর্কও ডাক পেল। 

কিন্তু অর্কের ঠাকুরদা ছিলেন সেখানকার একজন বিশিষ্ট সাধক। তিনি জানতেন অর্কের প্রতি রতনের মনোভাব। তাই অর্ক নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে বেরোনোর আগে তিনি সাবধান করলেন, “অর্ক, মনে রেখ, যাদের মনে তোমার প্রতি বিষ আছে, তাদের দেওয়া খাবার খেও না। খাবার কেবল শরীরেই যায় না, মনেও ছাপ ফেলে। আর অন্ন যদি আসে ঈর্ষাকাতর হৃদয় থেকে, তবে সে অন্ন অভিশাপ হয়ে ওঠে। অশুভ মন দিয়ে পরিবেশিত খাবার জীবনে বিষ ঢালতে পারে।”

অর্কর প্রথমে মনে হল, “ এ আবার কিরকম কথা ! খাবার তো স্থূল বস্তু। মন তো সুক্ষ্ম। তাই খাবারে আবার মনোভাবের ছোঁয়া লাগবে কিভাবে!” কিন্তু সে জানত যে তার ঠাকুরদা বিশিষ্ট সাধক। তাই সে তার ঠাকুরদার কথা মাথায় রাখল।

ভোজের দিন রতন খুব যত্ন করে অর্ককে সামনে বসাল। সে নিজে হাতে এক থালা খাবার এনে দিল অর্কের জন্যে। চারপাশে মশলার গন্ধ, ধূপের ধোঁয়া আর উৎসবের কোলাহল। অর্ক দেখল তার থালায় নানা রকম লোভনীয় পদ রয়েছে। কিন্তু অর্ক  বিনীতভাবে থালা না নিয়ে হাত জোড় করে বলল, “রতনদা, আজ আমি উপবাসে আছি। শুধু আপনার কথার সম্মান রাখার জন্যেই আজকে এসেছি।”

রতনের মুখে অস্বস্তির হাসি ফুটল। সে মূলতঃ লোক খাওয়াত কারণ সে জানত যে নিজের প্রারব্ধ কাটানোর সবচেয়ে বড় উপায় হল লোক খাওয়ানো। আর অর্ক তো খুবই ভালো সাত্বিক স্বভাবের যুবক। তাকে খাওয়াতে পারলে জীবনে ভালো ফল আসবেই। 

কিন্তু অর্ক সেই খাবার স্পর্শই করল না। তবে অর্ক খাবারের থালা ফিরিয়ে দিতেই পাসেবোস থাকা তার বন্ধু অতীন সেই থালা নিয়ে নিল। অতীনও বেশ জনপ্রিয় ছিল সেই গ্রামে। আর তাই রতন তার প্রতিও ঈর্ষা পোষণ করত মনে।

কিন্তু এই ভোজের কয়েকদিন পর খবর এল— সেদিন অতীন যে অর্কের ফিরিয়ে দেয়া প্লেট থেকে ভোজের খাবার খেয়েছিল, সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। জ্বর ও পেটের যন্ত্রণায় বেশ কাহিল হয়ে পড়েছে।

এরপর অর্ক ঠাকুরদার কাছে গিয়ে খুলে বলল সব কথা। সব শুনে ঠাকুরদা বললেন,
“এমনটা হবে আমি জানতাম।খাবার যখন কেউ খাওয়ায় তা শুধু নিছক খাদ্যদ্রব্য থাকে না। খাবারের সঙ্গে যে খাওয়াচ্ছে তার মনোভাবও মিশে যায়। যাদের মনে হিংসা আছে বা যাদের মন অন্যের ক্ষতি চায়, তাদের দেওয়া খাবারে মানসিক বিষের ছোঁয়া থাকে। অন্ন যে দাতার হৃদয়ের ছায়া বহন করে। আর তাই ঈর্ষাকাতর হৃদয় থেকে আসা অন্ন অভিশাপের ফল আনে জীবনে।”


#গল্পথেকেশিক্ষা
#আধ্যাত্মিকগল্প
#বাংলাগল্প
#মনেরশুদ্ধতা
#প্রেরণাদায়ীগল্প
#SpiritualStory
#BanglaStory
#EnergyInFood
#ToxicVibes
#PositiveVibesOnly
#MindAndFood
#DoNotEatNegativity
#StoryWithMessage
#ViralBangla

Thursday, 14 August 2025

শূন্যের আয়না - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

শূন্যের আয়না
 - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় 
(www.tarashisgagopadhyay.in)
 

পাহাড়ি পথে ধুলো উড়ছে। বিকেলের সোনালি রোদ ধীরে ধীরে গাছের ডালে গলে যাচ্ছে। সেই রোদে এক ধনী ব্যবসায়ীর ছায়া লম্বা হয়ে চলেছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে ব্যবসায়ীর পদধ্বনি ধুলো উড়িয়ে চলেছে। তার হাতে সোনার আংটি, রুপোর ঘড়ি, আর চোখে ক্লান্তির কুয়াশা। কপালে চিন্তার ভাঁজ।

সে অনেক দূরের এক আশ্রমের খোঁজে এসেছে। শোনা যায়, ওই পাহাড়ের চূড়ায় এক বৃদ্ধ সাধু থাকেন—যাঁর কথা, শুধু একবার শুনলেই মন শান্ত হয়।

ব্যবসায়ী পৌঁছল। পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট এক কুঁড়েঘর। ঘরের সামনে বসে আছেন সেই সাধু—গায়ে মলিন সাদা কাপড়, চোখে ঝলমলে স্বচ্ছতায় আকাশের বিস্তার, ঠোঁটে শিশুর মত প্রাণবন্ত হাসি।

ব্যবসায়ী প্রণাম করে বলল,
 “গুরুজী, আমার সব আছে—গাড়ি, বাড়ি, টাকা, জমি, ক্ষমতা। তবু অদ্ভুত এক অশান্তি আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আমি কী করলে শান্তি পাব?”
 
সাধু কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে।
তারপর জানালার বাইরে হাত দেখিয়ে বললেন,
 “ওই পাহাড়ের ঢালে পাইনগাছ দেখছ? বাতাস এলে তারা দুলে ওঠে, কিন্তু শেকড় থাকে মাটিতে। তোমার জীবন শুধু ডালে ভরা, শেকড়ের দিকে চোখ পড়ে না। তাই তোমার মনে এত অশান্তি।”

ব্যবসায়ী অবাক হয়ে বলল,
 “ঠিক বুঝলাম না।”

সাধু উঠে দাঁড়ালেন। তারপর তাকে নিয়ে গেলেন সেখান থেকে কিছুটা দূরে একটি পরিত্যক্ত খালি ঘরে— আরেকজন সাধু কিছুদিন আগে সেখানে থাকতেন। এখন তিনি চলে গেছেন। ঘরটি সম্পূর্ণ খালি।  মেঝেতে পড়ে আছে কোন ভক্তের দেয়া পুরনো মাদুর, কোণে মাটির কলসি। জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে দিনের আলো। তাতে যেন ঘরের ধুলোকনাও সোনালি মনে হচ্ছে।

তারপর বললেন, “এই ঘর খালি বলে এখানে হাওয়া ঢোকে, আলো ঢোকে। যদি আমি এখানে শেকল, বাক্স, বোঝা দিয়ে ভরে রাখতাম—তাহলে কি এই শূন্যতার সঙ্গ পেতে?”

ব্যবসায়ী কিছু বলতে গেল। কিন্তু সাধুর চোখের দিকে চেয়ে থেমে গেল।

সাধু বললেন, “তুমি তোমার জীবন হাজার বোঝায় ভরেছ, তাই নতুন কিছু ঢোকার জায়গা নেই সেখানে। মুঠো ভরে ধরলে কিছুই ধরা যায় না—হাত খুলে দিলে আকাশও ধরা দেয়।”

ব্যবসায়ী দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে বলল, “কিন্তু সব ছেড়ে দিলে আমি তো শূন্য হয়ে যাব!”

সাধু গভীর দৃষ্টিতে তাঁর দিকেচেয়ে বললেন,
 “শূন্য হওয়াই পূর্ণতার প্রথম ধাপ। নদী পুরনো জল সাগরে বিসর্জন দেয় বলেই নতুন স্রোত আসতে পারে তার বুকে। যে পাত্র ভরা, তার আর কিছু পাওয়ার নেই—যে পাত্র খালি, সেই অমৃত পায়।”

তারপর তিনি বললেন,
 “আজ রাতটা এখানে থেক। কোনো ফোন, খবর, হিসেব নয়—শুধু নীরবতাকে অনুভব কোর। বাতাস, আর নিজের শ্বাসের শব্দ শুনো প্রাণ ভরে।”

যথাসময়ে রাত এল।
পাহাড় জুড়ে জোনাকির আলো, দূরে নদীর ফিসফিস, আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র যেন গোপন কিছু লিখে রাখছে। ব্যবসায়ী সেই কুটিরে একলাই বসে রইল।প্রথমবার বুঝল - নীরবতারও সুর আছে। রাত গাঢ় হয়ে এসেছে। পাহাড়ের আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র ঝলমল করছে, যেন দূরের দেবলোক থেকে নিঃশব্দে তারা চেয়ে আছে তার দিকে। চারপাশে এতটাই নীরবতা যে নিজের হৃদস্পন্দনও ভালোমত শোনা যাচ্ছে। এখানে কয়েক ঘণ্টা বসে থাকার পর ব্যবসায়ী হঠাৎ অনুভব করল - বাতাসের স্পর্শে তার অন্তরের জটিল হিসেবগুলো যেন গলে যাচ্ছে, ঠিক যেমনভাবে চাঁদের আলো ধীরে ধীরে অন্ধকারের মধ্যে মিশে যায়।  এখানে তার সাথে কোনো ফোন নেই, কোনো ডায়েরি নেই, কোনো চুক্তিপত্র নেই—শুধু আছে নিজের অদ্ভুত হাল্কা শ্বাস, যা তার ভেতর থেকে সব ভার টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

রাত যখন গভীর হল ব্যবসায়ীর মনে হল - মুহূর্তটা যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তার অনুভব বলতে লাগল - এতদিন সে বাইরের জীবনের শব্দে ডুবে ছিল—টাকার টুংটাং, গাড়ির হর্ন, কথার ভিড়। এসব মিলেই আসলে তাঁর ভিতরের সত্যিকারের সুরকে চাপা দিয়ে রেখেছিল। আজ সেই শব্দের দেয়াল ভেঙে গেছে, আর ভেতর থেকে উঠছে এক দীর্ঘ নীরব ঢেউ - যা কোনো ভাষায় ধরা যায় না। সেই ঢেউয়ে ভেসে ব্যবসায়ী অনুভব করল—শূন্যতা আসলে অসীমে পূর্ণ হওয়ার অন্য নাম।

ভোরে যখন আকাশ সূর্যের সোনালি স্পর্শে রেঙে উঠল, ব্যবসায়ী যেন নিজের ভেতরে অনুভব করল - তার ভিতরে  আর কোন ভারী বোঝা নেই, আছে শুধু এক হালকা শ্বাস—যেন পাহাড়ের সাথে মিশে গেছে।

বিদায়ের সময় সে বলল,
 “গুরুজী, অনুভব করলাম — অশান্তির থেকে ত্রাণ পেতে হলে মনের বোঝা ফেলে দিতে হয়। শান্তি পেতে হলে ভিতরে শূন্য হতে হয়।”

সাধু মৃদু হেসে উত্তর দিলেন,
 “শূন্যের আয়নায় যা দেখা যায়, তা-ই চরম সত্য। তখন সেই স্তরে পৌঁছনো যায়  যেখানে তুমি নেই, আমি নেই — শুধু অসীম আছে। আর সেই অসীমের মাঝে নিজেকে নিবেদনেই আসে শান্তি।”

ব্যবসায়ী পাহাড়ের পথ বেয়ে নেমে গেল। মাত্র একটি রাতের নীরবতা  তাকে যেন শোনাল অপার শান্তির সুর। এই মুহূর্তে তার হৃদয় শান্তিতে পূর্ণ। কারণ তার চোখে যে ফুটে উঠেছে শূন্যের অসীম প্রতিচ্ছবি।


#বাংলা #বাংলালেখা #বাংলাব্লগ #বাংলাসাহিত্য #বাংলাকবিতা #বাংলাচিন্তা #বাংলাকথা #বাংলাদর্শন #বাংলাজীবন #বাংলাপ্রেরণা #বাংলাশিল্প #বাংলাঐতিহ্য #বাংলাপাঠ
#প্রেরণামূলক #দর্শন #জীবনদর্শন #মননশীলতা #চিন্তারজগৎ #অনুপ্রেরণা #জীবনউক্তি #আত্মজাগরণ #আধ্যাত্মিকতা #মানসিকশক্তি #আলোছড়াও
#বাংলাভ্রমণ #বাংলাঐতিহাসিক #ভ্রমণকাহিনী #ঐতিহাসিকতথ্য #বাংলারইতিহাস #তীর্থযাত্রা #ইতিহাসকথা #অতীতেরগল্প

Saturday, 9 August 2025

Kriya yoga - the path of silent lightChapter 1 – Beneath the Silent Mountains by Tarashis Gagopadhyay

Kriya yoga - the path of silent light

Chapter 1 – Beneath the Silent Mountains

The path to the upper terrace wound between ancient sal trees, their leaves whispering in the cool pre-dawn breeze. A pale ribbon of mist clung to the slopes, while far below, the Ganga murmured like an unseen sage reciting a hymn. The peaks of the Himalayas were still wrapped in shadow, but their snow crests caught the faintest touch of rose light, as though the sun itself had paused to bow before them.

Arun moved slowly, feeling the rough stone steps beneath his bare feet. Each step echoed faintly in the stillness, mingling with the river’s low roar and the occasional ringing note of a distant temple bell. He carried with him a quiet urgency. For weeks, questions about Kriya Yoga had stirred within him like restless birds. Now, on this morning, he would lay them before his master.

At the top of the steps stood the meditation hall, its carved wooden doors half-open, allowing a faint thread of sandalwood incense to drift into the cold air. Inside, the room was dim and still. The floor was covered in a faded carpet, worn soft by decades of sitting. At the far end, beneath a narrow eastern window, sat Guruji, his back perfectly straight, his hands resting lightly in his lap. His eyes were closed, yet the subtle curve of his lips suggested he was aware of everything—the wind outside, the river below, and the young disciple now kneeling at the threshold.

Arun bowed low, touching his forehead to the mat.
“Guruji,” he whispered, “I have come… with questions about Kriya.”

Slowly, Guruji’s eyes opened. They seemed to hold both the depth of a still lake and the boundless expanse of the mountain sky.
“Sit, my child,” he said, his voice warm yet steady. “Questions are the footsteps of the sincere seeker. If you ask from the heart, they will carry you to the heart of the truth.”

Arun crossed his legs before him, spine instinctively straightening. His breath quickened—not from the climb, but from anticipation.
“Guruji,” he began, “in books, I see the Chakras painted with colors, petals, Sanskrit letters… But in Kriya Yoga, how should I approach them?”

Guruji’s smile was almost imperceptible.
“In Kriya, we do not waste time painting pictures on the mind’s wall. The Chakras are not art for the imagination—they are living organs in the astral spine. They are steps on a mystic ladder that takes you to the soul. In the beginning, you only sense their place—approximately. With steady practice, perception sharpens. If you spend your energy creating mental colors, petals, and shapes, you may miss the true current of the practice.”

“Then… how will I truly know them?”

“When mind is silent,” he said, “when body is relaxed, and when the soul longs for the Infinite, the breath turns inward. Then the reality of the Chakras reveals itself. You will hear their subtle vibration, see their light, and feel their unique pulse. You will recognize the upward pull of each center. Kechari Mudra, when the ‘wind’ of the breath subsides, will help awaken this awareness.”

His tone grew quieter, but each word seemed etched in the air.
“Remember, there are two aspects to each Chakra. The inner aspect—its essence—is a vibration of light, drawing your awareness upward. The outer aspect is the life-giving force that nourishes your body. When you ascend the spine in Kriya Pranayama, imagine the Chakras as small twinkling lights in a hollow luminous tube. When descending, feel them distributing the cosmic energy into the body, as though rays are flowing from them into the regions before them.”

Arun's eyes drifted closed for a moment, trying to picture this living ladder of light.
“Guruji… please tell me where they are.”

Guruji’s back straightened slightly, his voice taking on the clarity of a mapmaker describing sacred terrain:
“Muladhara—at the base of the spine, just above the tailbone. Swadhisthana—midway between Muladhara and the navel. Manipura—in the lumbar region, level with the navel. Anahata—behind the heart, between the shoulder blades. Vishuddha—where neck joins shoulders; you can feel it if you sway your head gently, keeping your chest still. Above, you will find the Medulla at the top of the spinal cord—this is a gateway. From there, focus forward to Bhrumadhya, between the eyebrows. Steady yourself there, and the inner light will grow into the Kutastha—the spiritual eye—a radiant point at the center of an endless sphere of golden-blue light. This is the door to Divine Consciousness.”

Arun’s voice was almost a whisper. “And beyond that?”

“Beyond are subtler sanctuaries—the pituitary gland, counterpart to Ajna; the pineal, shaped like a pine cone, the crown jewel of sadhana when flooded with white light. There are two centers known as Roudri and Bama, above the left and right ears. At the back lies Bindu, the sacred whirl of hair. When higher Kriyas are mastered, Bindu opens to the Fontanelle—Sahasrara—the thousand-petaled lotus. Beyond even that is the eighth Chakra, thirty centimeters above the head, like a star above your crown.”

The Ganga’s voice seemed to swell in the distance, as if echoing his words.

“Guruji,” Arun asked, “how should I sit to begin this journey?”

“Face the east,” Guruji said. “In Half-lotus, the body is steady yet relaxed. Sit on the edge of a firm cushion so the hips rise slightly and the spine grows like the trunk of a young deodar tree. Reverse the legs when tired. Siddhasana is stronger—the heels pressing on the perineum and pubic bone, especially with Kechari, seal the pranic circuit. Padmasana is for the few whose bodies open naturally to it—force will only injure the knees. Remember this: it is not the complexity of the posture, but the steadiness of the spine that opens the gates.”

Arun shifted, adjusting his crossed legs, sensing the subtle alignment of his spine.
“And my hands, Guruji?”

“Interlock the fingers as Lahiri Mahasaya did. This unites the current of both sides of the body. In Kriya, Pranayama flows into meditation without break. One becomes the other, as river becomes ocean.”

The light through the window grew brighter, washing Guruji’s face in gold.

“Guruji,” Arun said softly, “what if I feel nothing? No light, no vibration—only darkness?”

Guruji leaned forward, his voice low but unwavering.
“Then you sit with that darkness as if it were your oldest friend. You do not chase it away. You breathe with it. One day, you will discover—it was light all along.”

Outside, the temple bell rang again. The sun crept over the snowy ridges, and in that moment, Arun felt that the mountains within had begun to open their gates.

রাখী প্রসঙ্গে... তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

রাখী প্রসঙ্গে...

 রাখী  হল ভারতীয় সংস্কৃতির এক অনন্য উৎসব, যা শুধু ভাই-বোনের সম্পর্ককেই নয়—স্নেহ, সুরক্ষা ও নৈতিক দায়িত্বের এক গভীর সংযোগের প্রতীক। আজকের দিনে এটি হয়তো উপহার ও মিষ্টির বিনিময়ে সীমাবদ্ধ মনে হতে পারে, কিন্তু এর ইতিহাস, পুরাণকথা ও দর্শন অনেক গভীরে প্রসারিত।

প্রথমে দেখা যাক ইতিহাস ও পুরাণে রাখীর বিষয়ে কি জানা যায়।

মহাভারত বলছে– দ্রৌপদী যখন শ্রীকৃষ্ণের আঙুলে আঘাতের ক্ষত দেখে নিজের শাড়ির অংশ ছিঁড়ে তাঁর হাতে বেঁধে দেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেন, যে কোনো বিপদে তিনি দ্রৌপদীর সুরক্ষা করবেন। এই আত্মীয়তাবোধই রাখীর মূল দর্শন—সুতোর বন্ধনে নৈতিক প্রতিশ্রুতি।

রাজপুত ইতিহাসে আমরা পাই রাখীর আরেকটি প্রসঙ্গ – কথিত আছে, মেওয়ারের রানি কর্ণাবতী মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে রাখী পাঠিয়েছিলেন, বাহ্যিক শত্রুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষার অনুরোধ জানিয়ে। হুমায়ুন যুদ্ধ ছেড়ে এসে তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। এটি প্রমাণ করে, রাখী শুধু রক্তের সম্পর্ক নয়—সততা ও সম্মানের সম্পর্কও হতে পারে।

সন্ত কবীরের দর্শনেও রাখীর উল্লেখ আছে। লোককথায় রয়েছে, কবীরের স্ত্রী লায়লা নাকি প্রতিবছর গুরু রামানন্দকে রাখী বেঁধে আশীর্বাদ গ্রহণ করতেন, যা রাখীর আধ্যাত্মিক দিককে প্রকাশ করে—গুরু-শিষ্যের বন্ধনও সুরক্ষার অঙ্গীকার বহন করে।

রাখী নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান ভারতীয় ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার যখন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে তখন বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদের আগুন জ্বলে ওঠার আশঙ্কা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ রাখীপূর্ণিমাকে শুধুমাত্র ভাই-বোনের ব্যক্তিগত উৎসবের গণ্ডি থেকে বের করে সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য দিয়েছিলেন। তিনি রাখী-বন্ধনকে পরিণত করেছিলেন ঐক্যের প্রতীকে যেখানে একে অপরের হাতে রাখী বেঁধে মানুষ পরস্পরকে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে জাতি ও সম্প্রদায়ের বিভাজন ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের এই উদ্যোগ রাখীপূর্ণিমাকে নতুন অর্থ দিয়েছিল। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, একটি ছোট্ট সূতোর বন্ধন ব্যক্তিগত সম্পর্কের বাইরে গিয়ে সমগ্র সমাজকে ঐক্যের সূত্রে বেঁধে দিতে পারে। তাঁর ভাষায়, “মানুষের হৃদয় যদি এক হয়, তবে কোনো শক্তিই তাকে আলাদা করতে পারবে না।”

এবার রাখীর প্রাচীন আচার ও অর্থ এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক।

রাখীপূর্ণিমা শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমায় পালিত হয়, যখন বর্ষার আকাশ পূর্ণিমার চাঁদের জ্যোৎস্নায় পরিপূর্ণ থাকে। দক্ষিণ ভারতে এই দিনে ঋষি-তর্পণ হয়, যেখানে ঋষিদের স্মরণ করা হয়। পশ্চিম ভারতে এটিকে নারিয়েল বা নারালী পূর্ণিমা বলা হয় যেহেতু এদিন সমুদ্র দেবতার উদ্দেশ্যে নারকেল নিক্ষেপ করা হয়। উত্তর ভারতে রক্ষাবন্ধন শব্দের প্রচলন বেশি—যেখানে রাখী হল "রক্ষা" ও "বন্ধন"-এর মিলন।

তাই সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে - রাখীর আসল শক্তি সুতোর গিঁটে নয়, প্রতিজ্ঞার বন্ধনে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সম্পর্ক শুধু জন্মসূত্রে নয়, বরং সচেতন প্রতিশ্রুতিতে গড়ে ওঠে। ভাইয়ের বোনকে বা বোনের ভাইকে সুরক্ষা দেয়া মানে কেবল শারীরিক নিরাপত্তা নয়, সাথে মানসিক আশ্রয়, নৈতিক সাহস ও আত্মিক ভরসা দেওয়া। একটি ছোট্ট সূতোর সম্পর্কের বন্ধন দেখতে ক্ষণভঙ্গুর হলেও, বিশ্বাস ও মর্যাদা তাকে অটুট করে তোলে।

তাই রাখী আমাদের শেখায়—"যে সম্পর্ক সুরক্ষার অঙ্গীকার বহন করে, সেই হল সত্যিকারের রাখীর বন্ধন।"

এবার আসা যাক আমার ব্যক্তিজীবনের প্রসঙ্গে। আমার নিজের কোন বোন নেই। তাই রাখী পরার কোন পাট আমার থাকার কথা নয়। তবে ফেসবুকের সূত্রে পরিচয় হবার পর পাঠিকা বোন বা দিদিরা অনেকেই এই লেখককে ভালবেসে রাখী পাঠান। সেগুলোই সানন্দে পড়ি। তবে সেসব ক্ষণিকের বোনেদের সাথে যোগাযোগ কিছু বছর পরপর সময়ের সাথে সাথে আবছা হয়ে যায়। এটাই স্বাভাবিক অবশ্য। জীবন যে পরিবর্তনশীল।

   তবে এই বছর আমি যাঁদের থেকে রাখী পেয়েছি তাঁদের থেকে আলাপের পর থেকে প্রতিবছরই পাই - মিনু, সুতপা, শিঞ্জিতা ও তনুশ্রী। তাই এদের আমি সত্যিকারের বোন বলেই মনে করি। ওদের জন্যে আজকের পোস্টে রইল ওদের এই দাদার পক্ষ থেকে অনেক স্নেহাশীষ ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা।

  আর বাকি যাঁরা ফেসবুক ও whatsapp এ ভার্চুয়াল রাখীর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বা এই পোস্ট দেয়ার পর এখানে জানাবেন তাঁদের সবাইকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। আপনারাও ভালো থাকবেন সবাই।
 
ইতি তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়।

#RakshaBandhan ❤️
#RakshaBandhan2025
#HappyRakshaBandhan
#RakhiLove
#RakhiCelebration
#SiblingLove 💛
#BrotherSisterBond
#BroSisGoals
#RakshaBandhanSpecial
#RakshaBandhanVibes
#RakhiFestival
#RakhiFullOfLove
#BondOfLove 💫
#BandhanOfProtection
#SiblingGoals
#RakshaBandhanMemories
#RakhiStory
#LoveAndProtection 
#রাখীর_সূতা
#রক্ষা_বন্ধন
#ভাইবোনের_ভালোবাসা
#সুরক্ষার_বন্ধন
#সম্পর্কের_সূতা
#ভাইবোন_গল্প
#ভালোবাসা_ও_বিশ্বাস
#রাখীর_গল্প
#ভাইবোনের_বন্ধন
#মানবিকতার_সূতা