ক্রিয়া যোগ — নীরব আলোর দিশায়
অধ্যায় ১ — নীরব পর্বতের কোলে
পাহাড়ের উপরের ওই আশ্রমের চাতালের দিকে ওঠা পাথুরে পথটি বেঁকে গেছে গভীর শালবনের মধ্য দিয়ে। ভোরের আগে-পরে হালকা ঠান্ডা হাওয়া পাতাগুলোকে মৃদুস্বরে দোলাচ্ছে — যেন শালবনের ভিতরে কোন অজানা ঋষি কোনো গোপন মন্ত্র জপকরে চলেছেন। পাহাড়ের গায়ে সাদা কুয়াশা নরম চাদরের মতো ঝুলে আছে। অনেক নিচে, গঙ্গা স্রোতের গভীর স্বরে গুনগুন করছে—যেন অদৃশ্য কোনো ঋষি অনন্তকাল ধরে স্তোত্রপাঠ করছেন।
দূরের হিমালয়ের তুষারশৃঙ্গগুলো তখনও ছায়ার ভেতর ঢাকা, কিন্তু প্রথম সূর্যালোকের ক্ষীণ আভা তাদের কপালে ছুঁয়ে গেছে—যেন সূর্য নিজেও আজ এই মহাশান্ত পাহাড়গুলিকে প্রণাম করছে।
অরুণ ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙছিল। পাথরের খসখসে ধাপগুলির উপর দিয়ে যাবার সময় পায়ের নীচে বেশ ঠান্ডা লাগছিল। প্রতিটি পদক্ষেপের শব্দ মিলেমিশে যাচ্ছিল দূরের মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি আর গঙ্গার গম্ভীর স্রোতের সঙ্গে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্রিয়া যোগ নিয়ে তার মনে নানা প্রশ্ন জেগেছিল। সেই প্রশ্নগুলো যেন অস্থির পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছিল ভেতরে। আজতাই সে ঠিক করেছে - এই ভোরে, গুরুজীর সামনে বসে সে উত্তর চাইবে।
চূড়ায় পৌঁছেই চোখে পড়ল ধ্যানকক্ষ—খোদাই করা কাঠের দরজা আধখোলা, ভেতর থেকে ভেসে আসছে চন্দনধূপের মিষ্টি গন্ধ। ভিতরে নীরবতা ঘন হয়ে আছে, যেন সময়ও থমকে গেছে। মেঝেতে বিছানো জীর্ণ কার্পেট বহু বছরের ধ্যানের স্পর্শে নরম হয়ে গেছে।
দূরের পূর্বমুখী জানলার নিচে গুরুজী বসে আছেন—পিঠ একদম সোজা, হাত আলতোভাবে কোলে রাখা, চোখ বন্ধ। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম এক হাসি—যেন তিনি জানেন বাইরে হাওয়ার শব্দ, নিচের নদীর গুঞ্জন, আর এই মুহূর্তে দোরগোড়ায় নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর শিষ্যের মনের সব কথা।
অরুণ নত হয়ে প্রণাম করল, কপাল ঠেকাল মাদুরে, “গুরুজী,” সে আস্তে বলল, “আমি এসেছি… ক্রিয়া সম্পর্কে কিছু জানার জন্য।”
গুরুজী ধীরে চোখ খুললেন—দুটি চোখ যেন গভীর হ্রদের শান্ত জলে আকাশের অসীমতা ধরা পড়েছে, “বসো, বৎস,” গুরুজীর কণ্ঠ উষ্ণ অথচ দৃঢ়, “প্রশ্ন হল সাধকের লক্ষ্যের দিকে ফেলা প্রথম আন্তরিক
পদক্ষেপ। সৎ হৃদয় থেকে উৎসারিত প্রশ্ন একদিন তোমাকে সত্যের হৃদয়ে পৌঁছে দেবে।”
অরুণ পদ্মাসনে বসল। মেরুদণ্ড অনায়াসে সোজা হয়ে গেল। উত্তেজনায় শ্বাস দ্রুত হচ্ছিল। সে বলল, “গুরুজী,” সে বলল, “বইয়ে দেখি চক্রগুলিকে নানা রঙে, পাপড়িতে, সংস্কৃত বর্ণে সাজানো হয়… কিন্তু ক্রিয়ায় আমি কীভাবে তাদের চিনব?”
গুরুজীর মুখে হালকা হাসি ফুটল, “ক্রিয়ায় আমরা মনের দেওয়ালে ছবি আঁকতে সময় নষ্ট করি না। চক্র কোনো কল্পনার ছবি নয়—এরা হল জীবন্ত কেন্দ্র, তোমার সূক্ষ্ম মেরুদণ্ডের ভিতরে স্থাপন করা। এগুলি হল আত্মার দিকে ওঠার সিঁড়ির ধাপ। শুরুতে তুমি শুধু তাদের অবস্থান আন্দাজে অনুভব করবে। কিন্তু অনুশীলন যত গভীর হবে, উপলব্ধি ততই স্বচ্ছ হবে। রঙ-পাপড়ি কল্পনা করতে গিয়ে অনেকেই আসল প্রবাহ হারিয়ে ফেলে।”
অরুণ একটু দ্বিধায় বলল,
“তাহলে… তাদের সত্য রূপ আমি কীভাবে জানব?”
গুরুজীর কণ্ঠ আরও শান্ত হয়ে এল, “যখন মন নীরব হয়, দেহ শিথিল হয়, আর আত্মা অসীমের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়—শ্বাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভেতরে ফিরে আসে। তখন চক্রগুলির নিজস্ব আলো, ধ্বনি, স্পন্দন ধরা দেয়। কেচরী মুদ্রা, যখন প্রাণবায়ু স্তব্ধ হয়ে যায়, সেই উপলব্ধিকে আরও গভীর করে তোলে।”
তিনি যেন বাতাসে অক্ষরে অক্ষরে মন্ত্র খোদাই করছিলেন, “প্রতিটি চক্রের দুটি দিক আছে—ভিতরের দিকটি হল আলোর কম্পন, যা চেতনাকে ওপরে তোলে। বাইরের দিকটি হল সেই জীবনশক্তি যা তোমার দেহকে পুষ্ট করে। চক্রের ভিতরের দিক অর্থাৎ তার মূল সত্তা হল এক সূক্ষ্ম আলোক-কম্পন, যা তোমার চেতনাকে টেনে নিয়ে যায় উপরের দিকে, আত্মার দিকে। চক্রের বাইরের দিক অর্থাৎ তার শারীরিক রূপ হল এক বিস্তৃত আলোকপ্রভা, যা তোমার দেহকে সঞ্জীবিত রাখে।
ক্রিয়া প্রণায়ামের সময়, যখন তুমি মেরুদণ্ডের পথে ধাপে ধাপে ওপরে উঠছ, তখন মনে হবে - চক্রগুলো যেন ছোট ছোট তারার মতো ঝিলমিল করছে - যেন ফাঁপা নলের মত দেখতে আমাদের মেরুদণ্ডের ভেতর কেন্দ্রে জ্বলছে।
আবার, যখন তোমার সচেতনতা ধীরে ধীরে নীচে নামবে, তখন চক্রগুলো মনে হবে যেন শক্তি বিকিরণের দুয়ার— যেখান থেকে উপরের অসীম উৎস থেকে আসা শক্তি তোমার দেহে ছড়িয়ে পড়ছে।
প্রতিটি চক্র থেকে দীপ্তিময় রশ্মি বেরিয়ে এসে তার সামনের অংশে প্রাণপ্রবাহ জাগিয়ে তোলে।”
অরুণ চোখ বুজল। নিজের মেরুদণ্ডের মাঝে সেই আলোর ধাপ অনুভব করতে চেষ্টা করল। তারপর বলল, “গুরুজী… দয়া করে তাদের অবস্থান একে একে বলুন।”
গুরুজী বললেন,
“মূলাধার—মেরুদণ্ডের গোড়ায়, লেজের হাড়ের বা tail bone এর ঠিক উপরে।
স্বাধিষ্ঠান—মূলাধার ও নাভির মাঝামাঝি।
মণিপুর—কোমরের কাছে, নাভির সমতলে।
চতুর্থ চক্র অনাহত—পিঠের মাঝ বরাবর হৃদয় চক্র রূপে এর অবস্থান। কাঁধের হাড় দুটো কাছে আনার সময় বা ঠিক নিচের টানটান পেশিতে মন দিলে টের পাবে। পঞ্চম চক্র হল বিশুদ্ধ—যেখানে গলা আর কাঁধ মিলেছে। মাথা আস্তে আস্তে দুই পাশে ঘোরালে, যে জায়গায় হালকা “কট কট” শব্দ শুনবে, সেখানেই এর আসন।
তবে ক্রিয়া প্রাণায়ামের অনুশীলনে তুমি শিখবে মেডুলা— অর্থাৎ মেরুদণ্ডের শীর্ষে থাকা সূক্ষ্ম কেন্দ্র—অনুভব করতে।
মেডুলায় মন স্থির করে ভ্রুমধ্য বা দুই ভ্রুর মাঝখান থেকে তুমি ভেতরের দৃষ্টি দাও— দেখবে সেখানে ক্ষীণ এক আলো জ্বলছে।
সেই আলোর স্থান থেকে প্রায় আট সেন্টিমিটার পেছনে গেলে পৌঁছবে ষষ্ঠ চক্র আজ্ঞায়।
এই আজ্ঞা চক্রকে বলা হয় আত্মার আসন। এই হল আধ্যাত্মিক জগতের দরজা। এখানে মন স্থির হলে, ভ্রুমধ্যের আলো বড় হতে হতে রূপ নেবে কূটস্থ বা আধ্যাত্মিক নয়নে—যেন অসীম আলোর গোলকের কেন্দ্রে এক দীপ্ত বিন্দু।
এই অভিজ্ঞতায় তুমি অনুভব করবে—পুরো বিশ্ব যেন তোমার নিজের দেহের মত। এটাই কূটস্থ চৈতন্য—যেখানে ভেতরের দরজা খুলে অসীমের সাথে মিলিত হওয়া যায়।
অরুণ আস্তে বলল, “তারপর?”
— “তারপরেও আছে। খেচড়ী মুদ্রায় জিভের ভেতর দিয়ে যে সূক্ষ্ম শক্তি প্রবাহিত হয়,তা মৃদু কম্পনে জাগিয়ে তোলে পিটুইটারি গ্রন্থিকে— মটরের দানার মতো ছোট্ট এই গ্রন্থি
মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের তলায় ঝুলে আছে। এটি হল
অদৃশ্য অথচ শক্তিধারার প্রবেশদ্বার। এটাই আজ্ঞা চক্রের শারীরিক প্রতিচ্ছবি,
যেন আত্মার জানালায় বাঁধানো একটি ক্ষুদ্র রত্ন।
এর ঠিক পেছনে, গভীর নীরবতায় লুকিয়ে আছে
পিনিয়াল গ্রন্থি - পাইনকোনের মতো আকার, প্রাচীন সাধকরা যার প্রতীক রেখেছেন মন্দির ও মূর্তির অলংকরণে। যখন এই কেন্দ্রে শ্বেত শুভ্র আধ্যাত্মিক জ্যোতি ফুটে উঠবে, তখন তুমি পৌঁছে যাবে সাধনার শিখরে— যেন সীমাহীন আকাশের মাঝে তোমার অন্তর হয়ে যাবে আলোর সূর্য।
কিন্তু রহস্য এখানেই শেষ নয়। স্বামী প্রণবানন্দ গিরি বলেছেন - মস্তিষ্কের ভেতরে আছে আরও দুটি গুপ্ত কেন্দ্র—রৌদ্রী ও বামা।
রৌদ্রী থাকে বাঁ দিকের আকাশে, বাঁ কানের উপরে। বামা ডান দিকের আকাশে, ডান কানের উপরে - যেন চেতনার দু’টি দরজা, যা খুলে দেয় উচ্চ ক্রিয়ার রাজপথে প্রবেশপথ।
যখন তুমি এই অঞ্চলগুলোতে ধ্যান করবে, মস্তিষ্ক রূপ নেবে দীপ্ত আলোর এক নগরীতে— প্রতিটি কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়বে সোনালি, নীল, আর শুভ্র রশ্মি, যা তোমাকে নিয়ে যাবে ক্রমশঃ উর্ধ্বে, অসীমের হৃদয়ের দিকে।”
দূরে গঙ্গার স্রোত যেন গুরুজীর বাক্যের প্রতিধ্বনি তুলল।
— “গুরুজী,” অরুণ বলল, “আমি এই যাত্রা শুরু করব কীভাবে বসে?”
— “পূর্বমুখী হয়ে বসো,” গুরুজী বললেন, “অর্ধপদ্মাসনে দেহ স্থির অথচ শিথিল রাখো। নিতম্ব সামান্য উঁচুতে রাখতে কুশন নিতে পারো—মেরুদণ্ড যেন দেবদারুর কাণ্ডের মতো সোজা হয়। ক্লান্ত হলে পা বদলাও। সিদ্ধাসন এক্ষেত্রে খুবই ভাল।এটি প্রাণের বৃত্ত সম্পূর্ণ করে। পূর্ণ পদ্মাসন আরো ভালো তবে সেটি কেবল তাঁদের জন্য, যাদের দেহ স্বাভাবিকভাবে মানিয়ে নিতে পারে এর সাথে। মনে রেখো—ভঙ্গির জটিলতায় নয়, মেরুদণ্ডের স্থিরতায় চক্রের দ্বার খোলে।”
অরুণ একটু সরে বসল। মেরুদণ্ডের সঠিক অবস্থান অনুভব করল, “আর হাত, গুরুজী?”
— “লাহিড়ী মহাশয়ের মত আঙুল জড়িয়ে ধরো—এতে শরীরের দুই পাশের প্রবাহ এক হয়। ক্রিয়ায় প্রাণায়াম ও ধ্যান অবিচ্ছিন্ন—যেন মোহনায় মুখোমুখি নদী আর সাগর।”
জানলা দিয়ে আলো এসে গুরুজীর মুখ সোনালি করে তুলল।
— “গুরুজী,” অরুণ ধীরে বলল, “যদি কিছু অনুভব না করি? যদি আলো বা কম্পন কিছুই না পাই—শুধু অন্ধকার যদি ভিড় করে আসে?”
গুরুজী সামান্য ঝুঁকে এলেন, “তাহলে সেই অন্ধকারকে প্রিয় বন্ধুর মত গ্রহণ কর। তাকে তাড়িয়ে দিও না। তার সঙ্গে শ্বাস নাও। একদিন তুমি বুঝবে—সে তো সবসময় আলো ছিল।”
বাইরে আবার মন্দিরের ঘণ্টা বেজে উঠল। সূর্য তুষারশৃঙ্গে উঠতে লাগল। সেই মুহূর্তে অরুণ অনুভব করল—অন্তরের বন্ধ কপাটগুলো ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে।
(ক্রমশ)
(যাঁরা পড়ছেন জানাবেন কেমন লাগছে। পাঠকদের অধিকাংশের ভালো লাগল তবেই দ্বিতীয় অধ্যায়ের লেখা শুরু করব।)
#ক্রিয়াযোগ #ক্রিয়াযোগবাংলা #বাংলাযোগ #ধ্যানযোগ #ধ্যানওসাধনা
#প্রাণায়াম #আধ্যাত্মিকযাত্রা #অন্তরযাত্রা #আত্মসাধনা #গুরুশিষ্য
#যোগেরগোপনবিদ্যা #সত্যঅন্বেষণ #শান্তিরপথ #আত্মজ্ঞান #যোগবাংলায়
#ক্রিয়াযোগ
#বাংলাযোগ
#ধ্যানওসাধনা
#অন্তরযাত্রা
#প্রাণায়াম
#আত্মসাধনা
#ধ্যানমার্গ
#যোগেরগোপনবিদ্যা
#আধ্যাত্মিকযাত্রা
#শান্তিরপথ
#ধ্যানযোগ
#গুরুশিষ্য
#সত্যঅন্বেষণ
#আত্মজ্ঞান
#যোগবাংলায়
No comments:
Post a Comment