শূন্যের আয়না
- তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
(www.tarashisgagopadhyay.in)
পাহাড়ি পথে ধুলো উড়ছে। বিকেলের সোনালি রোদ ধীরে ধীরে গাছের ডালে গলে যাচ্ছে। সেই রোদে এক ধনী ব্যবসায়ীর ছায়া লম্বা হয়ে চলেছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে ব্যবসায়ীর পদধ্বনি ধুলো উড়িয়ে চলেছে। তার হাতে সোনার আংটি, রুপোর ঘড়ি, আর চোখে ক্লান্তির কুয়াশা। কপালে চিন্তার ভাঁজ।
সে অনেক দূরের এক আশ্রমের খোঁজে এসেছে। শোনা যায়, ওই পাহাড়ের চূড়ায় এক বৃদ্ধ সাধু থাকেন—যাঁর কথা, শুধু একবার শুনলেই মন শান্ত হয়।
ব্যবসায়ী পৌঁছল। পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট এক কুঁড়েঘর। ঘরের সামনে বসে আছেন সেই সাধু—গায়ে মলিন সাদা কাপড়, চোখে ঝলমলে স্বচ্ছতায় আকাশের বিস্তার, ঠোঁটে শিশুর মত প্রাণবন্ত হাসি।
ব্যবসায়ী প্রণাম করে বলল,
“গুরুজী, আমার সব আছে—গাড়ি, বাড়ি, টাকা, জমি, ক্ষমতা। তবু অদ্ভুত এক অশান্তি আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আমি কী করলে শান্তি পাব?”
সাধু কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে।
তারপর জানালার বাইরে হাত দেখিয়ে বললেন,
“ওই পাহাড়ের ঢালে পাইনগাছ দেখছ? বাতাস এলে তারা দুলে ওঠে, কিন্তু শেকড় থাকে মাটিতে। তোমার জীবন শুধু ডালে ভরা, শেকড়ের দিকে চোখ পড়ে না। তাই তোমার মনে এত অশান্তি।”
ব্যবসায়ী অবাক হয়ে বলল,
“ঠিক বুঝলাম না।”
সাধু উঠে দাঁড়ালেন। তারপর তাকে নিয়ে গেলেন সেখান থেকে কিছুটা দূরে একটি পরিত্যক্ত খালি ঘরে— আরেকজন সাধু কিছুদিন আগে সেখানে থাকতেন। এখন তিনি চলে গেছেন। ঘরটি সম্পূর্ণ খালি। মেঝেতে পড়ে আছে কোন ভক্তের দেয়া পুরনো মাদুর, কোণে মাটির কলসি। জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে দিনের আলো। তাতে যেন ঘরের ধুলোকনাও সোনালি মনে হচ্ছে।
তারপর বললেন, “এই ঘর খালি বলে এখানে হাওয়া ঢোকে, আলো ঢোকে। যদি আমি এখানে শেকল, বাক্স, বোঝা দিয়ে ভরে রাখতাম—তাহলে কি এই শূন্যতার সঙ্গ পেতে?”
ব্যবসায়ী কিছু বলতে গেল। কিন্তু সাধুর চোখের দিকে চেয়ে থেমে গেল।
সাধু বললেন, “তুমি তোমার জীবন হাজার বোঝায় ভরেছ, তাই নতুন কিছু ঢোকার জায়গা নেই সেখানে। মুঠো ভরে ধরলে কিছুই ধরা যায় না—হাত খুলে দিলে আকাশও ধরা দেয়।”
ব্যবসায়ী দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে বলল, “কিন্তু সব ছেড়ে দিলে আমি তো শূন্য হয়ে যাব!”
সাধু গভীর দৃষ্টিতে তাঁর দিকেচেয়ে বললেন,
“শূন্য হওয়াই পূর্ণতার প্রথম ধাপ। নদী পুরনো জল সাগরে বিসর্জন দেয় বলেই নতুন স্রোত আসতে পারে তার বুকে। যে পাত্র ভরা, তার আর কিছু পাওয়ার নেই—যে পাত্র খালি, সেই অমৃত পায়।”
তারপর তিনি বললেন,
“আজ রাতটা এখানে থেক। কোনো ফোন, খবর, হিসেব নয়—শুধু নীরবতাকে অনুভব কোর। বাতাস, আর নিজের শ্বাসের শব্দ শুনো প্রাণ ভরে।”
যথাসময়ে রাত এল।
পাহাড় জুড়ে জোনাকির আলো, দূরে নদীর ফিসফিস, আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র যেন গোপন কিছু লিখে রাখছে। ব্যবসায়ী সেই কুটিরে একলাই বসে রইল।প্রথমবার বুঝল - নীরবতারও সুর আছে। রাত গাঢ় হয়ে এসেছে। পাহাড়ের আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র ঝলমল করছে, যেন দূরের দেবলোক থেকে নিঃশব্দে তারা চেয়ে আছে তার দিকে। চারপাশে এতটাই নীরবতা যে নিজের হৃদস্পন্দনও ভালোমত শোনা যাচ্ছে। এখানে কয়েক ঘণ্টা বসে থাকার পর ব্যবসায়ী হঠাৎ অনুভব করল - বাতাসের স্পর্শে তার অন্তরের জটিল হিসেবগুলো যেন গলে যাচ্ছে, ঠিক যেমনভাবে চাঁদের আলো ধীরে ধীরে অন্ধকারের মধ্যে মিশে যায়। এখানে তার সাথে কোনো ফোন নেই, কোনো ডায়েরি নেই, কোনো চুক্তিপত্র নেই—শুধু আছে নিজের অদ্ভুত হাল্কা শ্বাস, যা তার ভেতর থেকে সব ভার টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
রাত যখন গভীর হল ব্যবসায়ীর মনে হল - মুহূর্তটা যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তার অনুভব বলতে লাগল - এতদিন সে বাইরের জীবনের শব্দে ডুবে ছিল—টাকার টুংটাং, গাড়ির হর্ন, কথার ভিড়। এসব মিলেই আসলে তাঁর ভিতরের সত্যিকারের সুরকে চাপা দিয়ে রেখেছিল। আজ সেই শব্দের দেয়াল ভেঙে গেছে, আর ভেতর থেকে উঠছে এক দীর্ঘ নীরব ঢেউ - যা কোনো ভাষায় ধরা যায় না। সেই ঢেউয়ে ভেসে ব্যবসায়ী অনুভব করল—শূন্যতা আসলে অসীমে পূর্ণ হওয়ার অন্য নাম।
ভোরে যখন আকাশ সূর্যের সোনালি স্পর্শে রেঙে উঠল, ব্যবসায়ী যেন নিজের ভেতরে অনুভব করল - তার ভিতরে আর কোন ভারী বোঝা নেই, আছে শুধু এক হালকা শ্বাস—যেন পাহাড়ের সাথে মিশে গেছে।
বিদায়ের সময় সে বলল,
“গুরুজী, অনুভব করলাম — অশান্তির থেকে ত্রাণ পেতে হলে মনের বোঝা ফেলে দিতে হয়। শান্তি পেতে হলে ভিতরে শূন্য হতে হয়।”
সাধু মৃদু হেসে উত্তর দিলেন,
“শূন্যের আয়নায় যা দেখা যায়, তা-ই চরম সত্য। তখন সেই স্তরে পৌঁছনো যায় যেখানে তুমি নেই, আমি নেই — শুধু অসীম আছে। আর সেই অসীমের মাঝে নিজেকে নিবেদনেই আসে শান্তি।”
ব্যবসায়ী পাহাড়ের পথ বেয়ে নেমে গেল। মাত্র একটি রাতের নীরবতা তাকে যেন শোনাল অপার শান্তির সুর। এই মুহূর্তে তার হৃদয় শান্তিতে পূর্ণ। কারণ তার চোখে যে ফুটে উঠেছে শূন্যের অসীম প্রতিচ্ছবি।
#বাংলা #বাংলালেখা #বাংলাব্লগ #বাংলাসাহিত্য #বাংলাকবিতা #বাংলাচিন্তা #বাংলাকথা #বাংলাদর্শন #বাংলাজীবন #বাংলাপ্রেরণা #বাংলাশিল্প #বাংলাঐতিহ্য #বাংলাপাঠ
#প্রেরণামূলক #দর্শন #জীবনদর্শন #মননশীলতা #চিন্তারজগৎ #অনুপ্রেরণা #জীবনউক্তি #আত্মজাগরণ #আধ্যাত্মিকতা #মানসিকশক্তি #আলোছড়াও
#বাংলাভ্রমণ #বাংলাঐতিহাসিক #ভ্রমণকাহিনী #ঐতিহাসিকতথ্য #বাংলারইতিহাস #তীর্থযাত্রা #ইতিহাসকথা #অতীতেরগল্প
No comments:
Post a Comment