চন্ডীর অসুরদের প্রতীক রূপ
মালা গাঙ্গুলী - দাদা,চন্ডীতে আমরা তিনবার অসুরদের আবির্ভাবের কথা পাই। এদের কি কোনো প্রতীকি অর্থ আছে?
তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় : আছে বৈকি। চন্ডীতে মা তিনবার আবির্ভুত হয়েছিলেন তিন অসুর প্রবৃত্তির বোধের জন্যে। প্রথমবার মধু কৈটভ বধের জন্য,দ্বিতীয়বার মহিষাসুর বধের জন্যে আর তৃতীয়বার শুম্ভ নিশুম্ভ বধের জন্যে। এই তিন অসুরেরই আছে প্রতীকি রূপ।
মালা গাঙ্গুলী - মধু কৈটভ কিসের প্রতীক দাদা?
তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় : মধু কৈটভ হল মায়া ও মোহের প্রতীক। সৃষ্টির প্রথমে তারা আবির্ভুত হয়ে ব্রহ্মাকেই আক্রমন করেছিল। তাদের হাত থেকে বাঁচতে ব্রহ্মা অনন্ত শয়ানে শায়ী নারায়নের কাছে যায়। কিন্তু নারায়ণ যে তখন যোগনিদ্রায়। তাই তিনি দেবী চন্ডীর আবাহন করেন। অর্থাত - জীবনের শুরুতেই জীবকে আক্রমন করে মায়া ও মোহ। এরা আমাদের আসক্তির দুই রূপ। আমরা যাতে দৈবী সম্পদ লাভ করতে না পারি সেজন্যেই এই দুই আসুরিক বৃত্তি আমাদের চেতনাকে বেঁধে রাখে গন্ডিতে। মনের হুঁশ নিয়ে তো মানুষ। কিন্তু এই আসুরিক প্রবৃত্তি আমদের মনের হুঁশ কেড়ে নিয়ে তাকে বিষয়ে বেঁধে রাখে। আর তাই এর বধ আবশ্যক। আমাদের সসীম আমি হল অসুর আর অসীম আমি হল দৈবিশক্তি। তাই আসুরিক সন্কির্তন্তা থেকে মুক্তি পেতে আমার আসল আমি বা সোহং সত্বাকে জগতে হয় যা একমাত্র আমাদের মুলাধারে অবস্থিত মা জগতে পারেন। বিষয়কে দুরে সরিয়ে তাঁর সরণ নিলেই হয় এই মধু কৈটভ বধ আর সেটাই হল সাধকের প্রথম যুদ্ধের জয়।
মালা গাঙ্গুলী - দাদা, মহিষাসুর কিসের প্রতীক ?
তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় : মোহ এবং আসক্তি রক্ষা পেয়ে সাধক যখন সাধনায় মনোনিবেশ করে তখন তাকে আক্রমন করে কর্তৃত্ব বন্ধন। এই কর্তৃত্বের বন্ধনের প্রতীক হল মহিষাসুর। এই অসুর দিব্য ভাব হরণ করে তাকে জড়িয়ে দেয় কর্তৃত্বের বন্ধনে। সে তখন প্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টা করে সবার উপরে। অনেকটা মহিষাসুরের স্বর্গ জয়ের মত। একে জয় করতেও প্রয়োজন হয় দেবিশক্তির আবাহন। অর্থাত আগে চাই পুরুষকার (যা জ্ঞানের প্রতীক) এবং তার মাধ্যমে নিজে উদ্যোগী হয়ে শরনাগতির (যা ভক্তির প্রতীক) চেষ্টা।এই দুইর মিলন ঘটলেই শক্তি জাগরিত হয় এবং তাতেই আমাদের মনের অসুর মহিষাসুর রুপী কর্তৃত্বের বন্ধন কাটিয়ে ওঠা যায়।
মালা গাঙ্গুলী - শুম্ভ নিশুম্ভ কিসের প্রতীক দাদা?
তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় : শুম্ভ নিশুম্ভ হল অহংকার ও অভিমানের প্রতীক। সাধনার দুটি স্তর অতিক্রম করার পর শেষ স্তরে এই দুটি অসুর মনের মধ্যে জেগে ওঠে তাদের আসুরিক ভাব বজায় রাখার জন্যে। সাধকের অহংকার জাগানোর জন্যে কিছু গুনমুগ্ধের তোষামোদ তার মধ্যে জাগে অহংকার। আর সাধক তাদের স্তুতিতে ভুলে নিজের অহংকারকে এবং অভিমানকে ভগবান ভেবে বসে। এই অহংকার বড় ভয়াবহ। কিছুতেই না। যতই তাকে মারার চেষ্টা কর সে আবার জেগে ওঠে। এই দুই অসুরকেও বধের অস্ত্র শরনাগতি। সাধকের সামনে যতই তোষামোদ কেন,তার নিজেকে মনে করতে হবে তৃনাদপি ক্ষুদ্র এবং সে যাই করুক না কেন,যত বড় কাজই সে করে থাকুক না কেন,তার অন্তরে বিশ্বাস রাখতে হবে যে সবই হয়েছে ঠাকুরের কৃপায়। সে শুধুমাত্র নিমিত্ত। এই জ্ঞান অন্তরে জাগলে আসে শরনাগতি আর তাতেই বধ হয় আমাদের অন্তরের শুম্ভ নিশুম্ভ।