Ami Tarashis Bolchi

Ami Tarashis Bolchi
The blog of Tarashis Gangopadhyay (click the photo to reach our website)

Friday 26 February 2016

তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে কিছুক্ষণ ২

 তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে কিছুক্ষণ ২ (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

   অর্জুনবিষাদযোগ  - আমাদের সাধারণ মানুষদেরই প্রতীক 


  প্রশ্ন - আপনি এইমাত্র বললেন যে গীতা পাঠ করলেই মনকে স্থির করা যাবে। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব?
   তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় - গীতা পাঠ মানে শুধু পড়ে যাওয়া নয়। সেইসাথে তার অর্থ উপলব্ধিও দরকার। তাহলেই দেখবে - গীতার মধ্যে দিয়ে আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন ভগবান। প্রথমেই দেখ- প্রথম অধ্য্যায়ের নাম অর্জুনবিষাদযোগ।এটি হল অর্জুনের মোহের বর্ণনা। গীতা শুরু অর্জুনের আসক্তির মাধ্যমে এবং শেষ তার আত্ম উপলব্ধির মাধ্যমে মোহের অন্তের ভিতর দিয়ে। অর্থাত কিনা সাংসারিক জীবের কিভাবে মায়ার বন্ধন কাটিয়ে মূল লক্ষ্যে পৌছনো সম্ভব তাই এখানে কৃষ্ণ দেখিয়েছেন।
    প্রশ্ন - একটু বিশদে বুঝিয়ে দিন।
    তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় - দেখ - গীতার শুরু হচ্ছে ধৃতরাষ্ট্র উবাচের মধ্যে দিয়ে -
"ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুত্সবঃ।" ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করছেন - আমার পুত্ররা কুরুক্ষেত্রে মিলিত হয়ে কি করল?
    এই ধৃতরাষ্ট্র কে? ধৃতরাষ্ট্র হল অজ্ঞানের প্রতীক।অজ্ঞান থাকে কোথায়?মনের আড়ালে।অর্থাত ধৃতরাষ্ট্র হল অজ্ঞানরুপ মনের প্রতীক যা জন্মান্ধ। অজ্ঞান মন দেখতে পায় না যে তাঁর ভিতরেই ঈশ্বরের বাস।তাই সে ঈশ্বরকে সামনে পেয়েও তাঁর দিকে না গিয়ে নিজের থেকে উত্পন্ন মোহকে ধরে থাকে। এখানে মোহ কে? দুর্যোধন সহ কৌরবরা হল তাঁর মোহ। যদি সাধারণ জীবদের দিকে দেখ -প্রায় প্রত্যেকেই ধৃতরাষ্ট্র। সবাই নিজের ঘর সংসার সামলাতেই ব্যস্ত। অন্ধভাবে সংসারের জন্যে কাজ করে যায় - সে জন্যে শত অন্যায় তারা করে যায়।
   আর সঞ্জয় কে? সঞ্জয় হল সংযমের প্রতীক। অর্থাত এই অজ্ঞান রূপ ধৃতরাষ্ট্র সংযম রূপ সঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করছেন - তার মোহ থেকে উত্পন্ন দুর্যোধনরা কুরুক্ষেত্রে কি করছে?
   প্রশ্ন - তাহলে কুরুক্ষেত্রও কি প্রতীক?
   তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় - অবশ্যই। জানোই তো যে আমাদের শরীরকে বলে ক্ষেত্র। এখানে দৈবী প্রবৃত্তি এবং আসুরিক প্রবৃত্তির সংঘাত চলছে সবসময়ে। কুরু শব্দের অর্থ কর। অর্থাত যে ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত ধর্ম ও অধর্মের সংঘাত চলছে সেই হল কুরুক্ষেত্র। সেই হিসেবে দেখতে গেলে আমাদের প্রত্যেকের দেহ কুরুক্ষেত্র যেখানে দৈবী প্রবৃত্তি এবং আসুরিক প্রবৃত্তির সংঘাত চলছে সর্বদা। ধৃতরাষ্ট্রের এই প্রশ্নের উত্তরে সঞ্জয় কুরুপক্শ এবং পান্ডবপক্ষের ব্যুহ রচনার দৃশ্য তুলে ধরছেন। এই ব্যুহ রচনাও কিন্তু আমাদের মনের একেকটি অবস্থার প্রতীক। প্রতিটি নাম এখানে তুলে ধরছে আমাদের মনের একেকটি অবস্থার কথা।

 গীতা তত্ব - ২

প্রশ্ন - বলেন কি? পান্ডব কৌরবদের নামের মধ্যেও নিহিতার্থ আছে?
তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় - আছে বৈকি। সঞ্জয় গীতার সূচনায় দেখাচ্ছেন - দুর্যোধন দ্রোনাচার্যের কাছে গিয়ে কথা বলছেন সেনাদের ব্যুহ দিয়ে। আগেই বলেছি - দুর্যোধন হল মোহর প্রতীক। এই মোহ হল সব রোগের মূল কারণ। দুর্যোধন -অর্থাত দূর যো ধন। অর্থাত দূর বা দুষিত যে ধন তাই দুর্যোধন। আমাদের দুষিত ধন এই মোহ। এই মোহ যাকে আচার্য মানে সেই দ্রোণও কিন্তু প্রতীক। দ্বৈতভাবের প্রতীক।দ্বৈতভাব -অর্থাত আমি ও পরমাত্মা স্বতন্ত্র এই ভাব। যখনি নিজেকে আত্মারূপে না দেখে দেহরূপে দেখা হচ্ছে তখনি মোহর হাত শক্ত হচ্ছে। অদ্বৈত ভাব থেকে দ্বৈতভাবে নেমে গুরু দ্রোণ মোহকে আগলে রাখছেন। এই প্রসঙ্গে দুর্যোধন ও দ্রোণ যে পান্ডব ও কৌরবদের নাম বলছেন সেদিকে খেয়াল করলেই বুঝবে - এর প্রতীকি অর্থ।  
 প্রশ্ন -  কিরকম?
তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় - প্রথমেই দুর্যোধন আচার্যকে দেখাচ্ছেন পান্ডবদের ব্যুহ। বলছেন - ধৃষ্টদ্যুম্ন পরিচালিত ব্যুহ দেখতে। কে ধৃষ্টদ্যুম্ন? যে দৃড় মন শাশ্বত অচল চিরন্তনের পথে শরণাগত থাকতে পারে সেই ধৃষ্টদ্যুম্ন আর শুধু সেই হতে পারে সত্যের পথের নায়ক। এ প্রসঙ্গে পান্ডব পক্ষের যে বীরদের নাম করা হয়েছে তাঁরা হলেন - ভীম (ভাবের প্রতীক। এই ভাবের এমন শক্তি যে এর মাধ্যমে অব্যক্ত পরমাত্মাও আত্মার মাঝে সগুনে প্রকট হয়ে দর্শন দেন। ), অর্জুন (অনুরাগের প্রতীক),  যুধিষ্ঠির ( মনের সব সব যুদ্ধে যে স্থির থাকতে জানে),সাত্যকি (সাত্বিকতার প্রতীক), বিরাট (হৃদয়ের প্রসারতার প্রতীক ), ধৃষ্টকেতু (দৃর যার কর্তব্যজ্ঞান), চেকিতান (মন যেখানেই থাক তাকে ইস্ট চরণে নিয়ে আসার সংকল্পের প্রতীক),কাশীরাজ (কায়ারুপ কাশিকে আপন বিবেক অনুসারে চালানোর প্রতীক),পুরুজিত (স্থুল,সুক্ষ্ম,কারণ শরীরকে ইচ্ছামত চালনার প্রতীক),শৈব্য (সত্যর শ্রেষ্ঠতার প্রতীক ), সৌভদ্র অভিমন্যু ( অর্থাত শুভ আধার পেলে যে মন ভয়মুক্ত থাকে তার প্রতীক),দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলে 
(বাত্সল্য,লাবন্য,সহৃদয়তা, সৌম্যতা,স্থিরতা ) - এরা সবাই মহারথী। দেহ ক্ষেত্রে যে প্রতিনিয়ত মহারণ চলে এরাই সেই যুদ্ধ জেতাতে পারে।
 প্রশ্ন - তাহলে কৌরব পক্ষের বীররাও কি অসত প্রবৃত্তির প্রতীক?
তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় - তাছাড়া আর কি? দেখ - এরপর দুর্যোধন আপন পক্ষীয় নায়কদের কথা বলছেন - "ভবান ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিন্ জয়ঃ। 
                 অশ্বথামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তিস্তথৈব চ।"  এখানে প্রথমেই আছেন ভীস্ম -তিনি হচ্ছেন ভ্রমের প্রতীক। এই ভ্রম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টিঁকে থাকে। যেমন ছিলেন ভীষ্ম। সকল সেনার নিধনের পরেও শরশয্যায় বেঁচে ছিলেন তিনি। তার মত বীর হয় না। অজেয় তিনি। একমাত্র শরনাগতি ভিন্ন তাকে মারা যায়না। তিনি ইচ্ছামৃত্যু সম্পন্ন। এই ইচ্ছাই হল ভ্রম। এই ইচ্ছাই হল মায়া। এই ইচ্ছা থেকেই জগতের সৃষ্টি। যিনি কামনারহিত তার পতন হয় না। তিনি ব্রহ্মের সাথে এক হয়ে থাকেন। সাধনার শুরুতে থাকে অনন্ত ইচ্ছা। দেখতে দেখতে এসব কেটে গিয়ে একটাই ইচ্ছা থাকে ইস্ট দর্শন। অবশেষে তাও যখন কেটে যায় তখনি নিজের মধ্যে আত্ম সাক্ষাত্কার ঘটে। কিন্তু এই ইচ্ছার বিলুপ্তি না হব পর্যন্ত ভ্রমের নাশ হয় না। আর জতখ্হন ইচ্ছা বা আসক্তি থাকে ততক্ষণ সক্রিয় থাকে অবিদ্যা। এই ভীস্মকে বধ করতে তাই স্বয়ং ভগবানকে অস্ত্র ধরতে হয়েছিল। তাই সাধকের পক্ষে সহজে একে বধ করা সম্ভব হয় না। অতএব শরনাগতি অবলম্বন করে তাঁকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে হয়। তারপর আছেন কর্ণ - অহমিকার প্রতীক। একেও সরাসরি বধ অসম্ভব। তাই এখানেও ইষ্টের শরনাগতি চাই। আছেন কৃপাচার্য - ইনি হলেন কৃপা করার প্রতীক। সাধনপথে একটা স্তরে এলে সাধকের লোকমান্য হবার ইচ্ছা হয় -তিনি তখন অপরকে কৃপা করার প্রবণতা দেখান যা তার পতনের কারণ হয়। যেমন বিশ্বামিত্র দয়া করতে গিয়ে পতন দেকে এনেছিলেন নিজের। আসলে সাধনের পথে অনেক সিধ্ধাই আসে। অনেকে সেগুলো লোকমান্য হবার জন্যে ব্যবহার করে আর তাতে লোকের কাছে নিজেকে ব্ড় দেখানোও হয় কিন্তু তাতে সাধন শক্তির নাশ হয়ে সাধক পতিত হন। অশ্বথামা হল আসক্তির অন্য নাম। দ্বৈত আচরণের ফলেই আসক্তির জন্ম আর তাই দ্রোনের পুত্র অশ্বথামা। এই আসক্তিই ঘটিয়েছিল দ্রোনের পতন ও মৃত্যু। এই অশ্বথামা অমর। কারণ আসক্তির শেষ নেই - নিবৃত্তির শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ বাধা দিয়ে যায়। আছে বিকর্ণ যা বিকল্পের প্রতীক। সাহ্নার চরম শিখরে এসেও সাধকের মনে হয় -ঈশ্বরের কাছ থেকে কি বিকল্প শক্তি যেমন সিধ্ধাই পাওয়া যেতে পারে।এই সিধ্দাই কিন্তু সাধনে বিরাট বাধা আনে। এছাড়া আছেন সৌমদত্তি ভুরিশ্রবা। এই ভূরিশ্রবা হলে ভ্রমাত্বক শ্বাসের প্রতীক। সাধনায় উন্নত স্তরে পৌছলে যখন সবাই সাধকের প্রশংসা করেন তখন সেই ভুরি ভুরি প্রশংশাতে যারা অভিভূত হয়ে যান তাদেরই বলা হচ্ছে ভুরিশ্রবা। তবেই দেখছ -কৌরব পক্ষের নায়করা সবাই সাধনপথের বহির্মুখী প্রবৃত্তির অঙ্গ যা সহকের সর্বনাশ করে আর পান্ডব পক্ষের নায়করা হলেন সব সাধনপথের নিবৃত্তি লাভের সহায়ক। 
                                        ৩
 প্রশ্ন - কিন্তু তাহলে দুর্যোধন এখানে কেন বলছেন যে ভীম দ্বারা রক্ষিত সৈন্যদলকে জয় করা সহজ কিন্তু ভীষ্ম দ্বারা রক্ষিত সৈন্যদের পরাস্ত করা অসম্ভব?  
তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় - বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে দুর্যোধন বলছেন যে তাদের আছে ১১ অক্সৌহিনী সৈন্য আর পান্ডবদের মাত্র ৭ অক্সৌহিনী সৈন্য। কিন্তু এখানে আসল হল দুই রক্ষকের নাম - ভীম ও ভীষ্ম। আগেই বলেছি - ভীস্ম হল ভ্রমের অন্য নাম। আর ভ্রমের ইচ্ছামৃত্যু। ইচ্ছার মাধ্যমে সংকল্প করে এই মায়ার ভ্রমকে জয় করতে না পারলে অবিদ্যার বিরূদ্ধে জয়লাভ অসম্ভব। সাধনার শুরুতে ইচ্ছা থাকে অনন্ত আর যত সাধনপথে এগোনো যায় ইচ্ছা কমতে থাকে। অবশেষে সব গিয়ে থাকে শুধু পরমাত্মা প্রাপ্তির ইচ্ছা। আর এই পরমাত্মা  প্রাপ্তি ঘটলে ইচ্ছার সমূলে বিনাশ হয় আর তখনি ভ্রম নির্মূল হয়। অর্থাত তখন ঘটে ভীস্ম বা ভ্রমের ইচ্ছামৃত্যু। তাই ভীষ্ম দ্বারা রক্ষিত অবিদ্যার সৈন্য প্রায় অজেয়। 
   অন্যদিকে দেখো , দুর্যোধন বলছেন - ভীম দ্বারা রক্ষিত পান্ডব সৈন্যদলকে হারানো কঠিন নয়। কারণ এদের সেনাপতি ভীম। ভীম ভাবের প্রতীক। ভাবের সেই ক্ষমতা আছে যার টানে স্বয়ং ভগবান দেখা দেন। এই ভাবের দ্বারাই পুণ্যময় প্রবৃত্তির বিকাশ ঘটে মানুষের মাঝে। কিন্তু ইষ্টের প্রতি ভক্তিতে যদি ভেজাল আসে,অর্থাত ভক্তিতে যদি কামনা প্রবেশ করে,তবে ভাবের ঘরে অন্ধকার নামে।তাতে কামনা পূর্ণ না হলেই ইষ্টের প্রতি শরনাগতি টলে যায়। তাই ভাবের পরিবর্তন ঘটলেই পতন  নিশ্চিত। তাই দুর্যোধনের মতে - ভীম রক্ষিত সেনাদের জয় করা সহজ।   
প্রশ্ন - গীতার এই অধ্যায়ে দেখা যাচ্ছে সবাই একেকটি অদ্ভুত নামের শঙ্খ বাজাচ্ছেন। এর কি কোন আলাদা তাত্পর্য আছে ?
তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় - আছে বৈকি। প্রথমেই বলি কৃষ্ণের শঙ্খর কথা। কৃষ্ণ বাজাচ্ছেন পাঞ্চজন্য। এই পাঞ্চজন্য হল পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিযকে পাঁচ তন্মাত্রা বা শব্দ,স্পর্শ,রূপ,রস গন্ধর রসে সিঞ্চিত করে তাদের দমন করে রাখার প্রতীক। অর্থাত এই নামের মাধ্যমে কৃষ্ণ বোঝাচ্ছেন -সব বাহ্য বিষয় ত্যাগ করে এবং সেদিকে সামান্য মনযোগ না দিয়ে ধ্যানে ইষ্টের প্রতি মন নিবিষ্ট করতে। 
  তারপর দেখ,অর্জুন বাজালেন দেবদত্ত শঙ্খ। আগেই বলেছি,দৈবী সম্পদের প্রতি অনুরাগ হল অর্জুন। যখন ইস্টকে ভালবাসা ছাড়া অন্য কিছুর উপর সামান্য আকর্ষণ থাকেনা সেই অবস্থাই  হল অনুরাগ। আর এই অনুরাগ মনে জাগলেই দৈবী সম্পদের উপর প্রভুত্ব সাধকের করায়ত্ত হয় না চাইতেই। সত্যিকারের সাধক এই সম্পদ বহিরঙ্গের কাজে না লাগিয়ে তা ঈশ্বরের প্রতি নিবেদন করে দেন যা তার সিদ্ধি তরান্বিত করে। 
  ভীম বাজালেন পৌন্দ্র শঙ্খ।এর অর্থ প্রীতি। আগেই বলেছি -ভীম হল ভাবের প্রতীক আর এই ভাবের সঞ্চার হয় প্রীতির মাধ্যমে। হৃদয়ে প্রেম থাকলে তবেই হয় ভাবের প্রকাশ। 
   ধর্ম রূপ যুধিষ্ঠির বাজালেন অনন্ত বিজয় শঙ্খ।অর্থাত -ধর্মকে ধরে থাকলে বিজয় অনিবার্য। আর এই বিজয় হল অনন্ত ,অর্থাত পরমাত্মাকে লাভ করে তার মাঝে স্থিতিলাভ সম্ভব তাঁর মত সত্যের পথে চললে। 
     নিয়মের প্রতীক নকুল বাজালেন সুঘোষ শঙ্খ। অর্থাত সাধক যখন যথার্থ ভাবে নিয়ম পালন করবেন সদাচারের জন্যে তখন তার অশুভ প্রবৃত্তি সব বিলীন হয়ে যাবে। আর শুভ বুধ্হির উদয় হবে। 
     সত্সঙ্গ রূপ সহদেব বাজালেন মনিপুশ্পক শঙ্খ। সাধকরা শ্বাসকে বলেন মনির সমতুল্য। বহিরঙ্গে মহাত্মাদের বাণী শুনে মনকে প্রভাবিত করে যাঁরা আত্মায় ডুব দেন,অর্থাত নিজ মন স্থির করে ঈশ্বরের চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকেন তাই হল যথার্থ সত্সঙ্গ।  চিন্তন,ধ্যান ও সমাধির মাধ্যমে ইষ্টের সাথে এই সত্সঙ্গ সম্ভব হয়। যতই ইষ্টের সান্যিধ্যে মন স্থির হবে ততই আসবে শ্বাসের উপর নিয়ন্ত্রণ। এতে ইন্দ্রিয়ের সাথে মন আসবে নিয়ন্ত্রণে। এই আত্মার সাথে মনের সত্সঙ্গ সফল হলে প্রতিটি শ্বাসের উপর নিয়ন্ত্রণ আসবে যা সাধককে নিয়ে যাবে মোক্ষের লক্ষ্যে। 
   প্রশ্ন - এবার আসি অর্জুনবিষাদযোগের মূল প্রশ্নে। অর্জুন যখন কৃষ্ণকে রথ স্থাপন করতে বললেন দু পক্ষের সেনাদলের মধ্যে,তখন তার মধ্যে যে বিষাদ জাগলো,এটা কি ইঙ্গিত বহন করে?
   তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় -  অর্জুন যখন কৃষ্ণকে রথ স্থাপন করতে বললেন দু পক্ষের সেনাদলের মধ্যে তখন তাঁর লক্ষ্য ছিল - যাতে দু পক্ষের সৈন্যদের পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। সাধনার পূর্বে ঠিক এই জায়গায় আসতে হয়। নিজের সকল প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মাঝখানে দাড়িয়ে নিরপেক্ষভাবে নিজেকে বিচার করতে হয়। অর্জুনও তাই করছিলেন। অনুরাগী ভক্তের জীবনে এ এক পরীক্ষা। এই পরীক্ষার লগ্নে যেটা অন্য ভক্তদের হয়,অর্জুনেরও তাই হল। যে অনুরাগ ভক্তকে ভগবানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় সেই অনুরাগেরই কাঁচা রূপ হল মোহ। মোহ অনুরাগীকে দেখায় -চারপাশে এই যে সংসার,এই যে সব আত্মীয় এদের নিয়েই তো সংসার। এদের বাদ দিয়ে জীবনের সার্থকতা কি? মোহবশে ভক্ত দেখেন - তার সাধের সংসারের থেকে এবার তাঁর বিচ্ছেদ আসন্ন। ফলে তার মনে জাগে বিষাদ। অর্জুনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আর নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্যে তিনি  টেনে আনলেন সনাতন কুলধর্মের কথা - স্বজনদের বধ করলে কুলনাশ হবে,কুলধর্ম নাশ হবে,কুলধর্ম উচ্ছন্নে গেলে কুলস্ত্রীরা ভ্রষ্টা হবে ও তাদের পরপুরুষের প্রতি আসক্তি আসবে,তার  ফলে বর্ণসংকর জন্ম নেবে। এদিকে যথার্থ উত্তরসুরীর অভাবে পিতৃপুরুষদের পিন্ড লোপ পাবে। ফলে পিতৃপুরুষরা নরকে যাবে। শুধু কুলধর্ম নিয়ে ভাষণ -তাই নয়,অর্জুন এইসাথে বলছেন - আমরা জ্ঞানী হয়েও এই মহাপাপ করব কেন ? অর্থাত মোহকে রক্ষা করার জন্যে তার মধ্যে জেগেছে অহমিকা। তিনি শুধু  যে বলছেন তিনি জ্ঞানী,তাই নয়,সাথে "আমরা" শব্দটি ব্যবহার করে বলছেন এই মহাপাপ কৃষ্ণও  করছেন তার সাথে। আর তারপর সেই পাপ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে তিনি ধনুর্বান ত্যাগ করে রথে বসে পড়লেন। তবেই দেখ, মানুষ যখন মোহের কবলে পরে তখন তার মধ্যে অহমিকা জাগে জ্ঞানের আর সংসার এবং আত্মীয়স্বজনদের প্রতি আসে আসক্তি -তখন সে ভগবানকেও পাপী ভাবতে পারে বুদ্ধির অন্তর্ধানে। এটি হল অনুরাগের কাঁচা স্তর -সেখানে সবকিছুই আমার বলে মনে হয় এবং কিছুই ছাড়তে চায় না মন। কিন্তু অনুরাগ যখন মোহের স্তর পেরিয়ে প্রেমের চৌকাঠে পা দেয় তখন এই কাঁচা স্তর পাকা হয়ে যায় ইস্ট কৃপায়। তখন আর সব আমার মনে হয় না - মনে হয় আমি শুধু ঈশ্বরের। আর চারপাশে যা আছে সবই তাঁর অংশ যা প্রকারান্তরে আমার অংশ। তখন বোঝা যায় -শরীরের আত্মীয়তা অজ্ঞানজনিত।আমার পিতামহ,আমার জ্যেঠা,আমার ভাই -এসবই  অজ্ঞানের সম্পর্ক। কারণ দেহটাই তো অনিত্য। তাই দেহের সম্পর্ক কিভাবে শাশ্বত হবে? 
   সাধারনতঃ সাধনার প্রারম্ভে আসে মোহ - তখনি আমার আমার ভাব জাগে সবার প্রতি। এই মোহ ঈশ্বরের থেকে মানুষকে আড়াল করে রাখে। কিন্তু যখন এই মোহ নাশ হয় তখনি ভক্ত পায় ঈশ্বরের দেখা। অর্জুন গীতার প্রারম্ভে সাধারণ জীবের মত শুধু রাজ্যসুখ ভোগই শ্রেষ্ঠ ভাবছেন - এর বাইরে যে কিছু থাকতে পারে তা তার মাথায় নেই। অতএব দেখাই যাচ্ছে - আর পাঁচজন অনুরাগী ভক্তের মতই অর্জুন প্রার্থিব সুখকেই শ্রেষ্ঠ ভাবছেন। তাই তার মনে মোহের সম্পর্কের বন্ধন হারানোর বিষাদ জেগেছে। এই জায়গা থেকে কত ভক্ত হারিয়ে যান। কিন্তু অর্জুন হারাননি। কারণ তিনি শরণাগত। নিজের জীবনরথ তুলে দিয়েছেন ভগবানের হাতে।আর স্বয়ং ভগবানকে সারথী করতে পেরেছেন বলেই এই বিষাদ কাটিয়ে ভগবান তাঁকে এগিয়ে দিয়েছেন পরম প্রাপ্তির পথে।                                       
    প্রশ্ন - কিন্তু অর্জুন যখন শরণাগত তার মনে বিষাদ আসা কি সঙ্গত?
    তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় - সঙ্গত নয়। কিন্তু এযে ঠাকুরের লীলা। তিনিই  ভক্তদের গীতা উপহার দেয়ার জন্যে অর্জুনের মনে এই বিষাদ আনিয়েছেন।  বিষয়ের প্রতি মোহ থেকেই যদিও বিষাদ আসে তবে বিষাদকে ছোট করাও ঠিক নয়। মানুষকে জাগতিক জগত থেকে ভক্তির পথে আনতে বিষাদের ভুমিকা বিরাট। জাগতিক জগত থেকে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করার সীমান্ত এই বিষাদ। বিষাদ যখন মনে জাগে তখন জল আসে চোখে। ভিতর থেকে আসে কান্না। যথার্থ শরণাগত ভক্ত যখন চোখের জল ফেলে বা বিষাদে আচ্ছন্ন হয় তখন ঠাকুর কৃপা করে নেমে আসেন পাশে। ভক্তের হাত ধরে তাকে তরিয়ে দেন। গীতার মাধ্যমে সেই নিদর্শন দেখিয়েছেন পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ।                           
 (ক্রমশঃ)