গুরু গুরু শব্দের অর্থ কি? গুরু শব্দ ভাগ করলে দেখা যাবে - 'গু' আর 'রু'। এর
এর মধ্যে 'গু' শব্দের অর্থ - অজ্ঞানের অন্ধকার যার মধ্যে জীবজগত নিমজ্জমান। আর 'রু 'শব্দের অর্থ হলো জ্ঞানের আলো যা আমাদের অজ্ঞানের জগত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় জ্ঞানের আলোর জগতে। অর্থাৎ - গুরু হলেন সেই ব্যক্তিত্ব যিনি আমাদের ভিতরকার অজ্ঞানের অন্ধকার নাশ করে মন্ত্রের সাহায্যে আমাদের মধ্যে শক্তিসঞ্চার করে এগিয়ে দেন মহাজীবনের পথে। জীবনমৃত্যুর বন্ধন থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে গুরু বিনা গতি নেই।
জীবনের যেকোনো দিকে এগোতে হলেই প্রয়োজন হয় একজন পথপ্রদর্শক বা গাইড যিনি সেই পথ সম্বন্ধে বিশদভাবে জানেন। যেমন শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক তেমনই আধ্যাত্মিক শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরু। যেমন অন্ধের রাজ্যে যে দেখতে পায় সেই হয় রাজা তেমনই আধ্যাত্মিক পথেও যে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে নিজের অভিজ্ঞতা,সাধনশক্তি,মন্ত্রশক্তি ও নিজের ভালবাসা দিয়ে সবাইকে পথের দিশা দেখাতে পারে সেই হলো যথার্থ গুরু।
আজকালকার দিনে বেশিরভাগই দেখা যায় গুরুতে গুরুতে রেষারেষি - সেই অনুযায়ী শিষ্যরাও 'আমার গুরুই শ্রেষ্ঠ' এমন একটা ভাব নিয়ে ঝগড়া চালিয়ে যায়।কিন্তু ঘটনা হলো - গুরু কিন্তু আদতে কোনো ব্যক্তি নয় ; গুরু হলেন মহাদেবের শক্তি। সেই শিবশক্তি প্রতিটি মানুষের মধ্যে থেকে তাকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু মুশকিল হলো - ভিতরের সেই গুরু থাকেন সুপ্ত অবস্থায়। তাঁকে জাগাতে হয়। আর সেজন্যেই প্রয়োজন হয় মানব দেহধারী একজন গুরুকে।সেই গুরু হলেন অনেকটা চাঁদের মত যিনি সাধনার মাধ্যমে নিজে পৌঁছতে পেরেছেন সেই আলোকিত স্তরে যেখানে ইষ্টকৃপা তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে শিষ্যকে আলোকিত করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে আলোর পথে। তাই শিষ্যের উত্তরণ গুরুর মাধ্যমে হলেও সেটি কিন্তু তিনি ঘটান না ; তাঁর শিষ্যের প্রতি ভালবাসা,স্নেহ ও কৃপা এবং শিষ্যের অধ্যবসায় ও গুরুভক্তি দেখে ইষ্ট কৃপা করেন। এমনকি অনেকসময়ে গুরুর রূপ ধরেই ইষ্ট শিষ্যের কল্যাণ করেন - এমন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে। তাই সকল গুরুর শক্তিই সেই এক - মহাদেবের শক্তি। মহাদেবই আসল গুরু - বাকিরা সবাই তাঁর প্রতিনিধি। তবে ইষ্টের প্রতিনিধি বলেই শিষ্যের কাছে ইষ্টের সমতুল্য হলেন গুরু।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে - গুরু হবার qualification কি?যে কেউ কি গুরু হতে পারেন? না। গুরু তাঁরাই হতে পারেন যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে সাধনা করেছেন,ইষ্টের কৃপা পেয়েছেন এবং যাঁদের মধ্যে আমিত্ব নাশ হয়েছে। গুরুর কোনো ধর্ম বা সংকীর্ণতায় নিজেকে আবদ্ধ রাখা ঠিক নয়। যার মধ্যে আধ্যাত্মিক জ্ঞান রয়েছে তাকেই কৃপা করা উচিত। শিষ্য ভক্তদের প্রতি তাঁর প্রেম ও ভালবাসা হওয়া উচিত নিস্বার্থ। তাঁর হওয়া উচিত অনন্ত প্রেম,অনন্ত জ্ঞান আর অনন্ত আনন্দের সঙ্গম।
আজকের দুনিয়ায় গুরু আছেন দুরকম - সদগুরু (যাঁরা সংখ্যায় কম) এবং বদ্গুরু(যাঁরা সংখ্যায় বেশী); এর মধ্যে সদ্গুরুদের কথা তো বললাম। এবার আসি বদ্গুরুদের কথায় - কিভাবে তাদের চিনবে -
১) বদ্গুরুরা সবসময়ে দেখান যে শিষ্যরা inferior এবং একমাত্র তাঁর মহত্বের কৃপাতেই শিষ্যদের উন্নতি সম্ভব। অর্থাৎ এদের মধ্যে আমিত্বের ভাব প্রবল থাকে।
২) এদের মধ্যে সম্পদ ও নারীদের প্রতি দৈহিক আকর্ষণ থাকে বেশী।
৩) এরা যশখ্যাতির কাঙ্গাল হয় এবং সবকিছুতেই নিজের ক্রেডিট নিতে চায়।
৪)এরা কখনো নিজেকে উজাড় করে শিষ্যকে শেখায় না।এদের ভয় থাকে -সব শিখিয়ে দিলে তার গুরুত্ব কমে যেতে পারে।
তাই গুরু না হওয়া পর্যন্ত 'গুরু-গুরু' করে ছটফট করা ঠিক নয়।এতে বদ্গুরুদের কাছে গিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সময় হলে গুরু আপনিই আসেন জীবনে বা শিষ্য গিয়ে পরে তাঁর কাছে।আর তখন শিষ্যর মনে যেমন ধরা দেয় ভাব যে ইনিই আমার গুরু তেমনি গুরুর শিষ্যকে দেখেই চিনতে পারেন। তখনই হয় যথার্থ দীক্ষা।সেই সময় না আসা পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের ধৈর্য ধরে নিজের পছন্দমত দেবদেবীর নাম জপ করে যেতে হয় যাতে তার ভিতরে দীক্ষালাভের গুণগুলো জেগে ওঠে। একমাত্র তবেই তো জীবনে আসেন গুরু এবং তারপর তাঁর কথা মেনে চললে সার্থক হয় জীবন।