Ami Tarashis Bolchi

Ami Tarashis Bolchi
The blog of Tarashis Gangopadhyay (click the photo to reach our website)

Friday 4 October 2013

মহাভারত রূপকের আলোয়

                                 মহাভারত রূপকের আলোয় 


   মহাভারত মহাগ্রন্থ আমাদের কাছে দ্বাপর যুগের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু মহাভারত লেখা হয়েছে একইসাথে সাধকদের জন্যে এবং সমাজের জন্যে।আমরা মহাভারতকে যদি বিশ্লেষণ করি তবে জানতে পারব - এর ভিতর দিয়ে কিভাবে সাধনার সংকেত দেয়া রয়েছে। এখানে দ্রৌপদী বা কৃষ্ণা হলেন দেহের রূপক।পঞ্চপান্ডব হলেন পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রতীক।দেহের সাথে পাঁচ ইন্দ্রিয়র বিবাহ দিয়ে শুরু জীবনের যাত্রাপথ।যখনই জীবাত্মা জীবশরীর ধারণ করে তখনই পঞ্চ ইন্দ্রিয় জেগে ওঠে তার মধ্যে।দ্রৌপদীর সাথে পাঁচ পান্ডবের বিয়ে সেই তত্বটি তুলে ধরেছে।এবার আসা যাক পান্ডবদের জন্ম প্রসঙ্গে। কোন পান্ডব কিন্তু সাধারনভাবে জন্মায়নি। তারা কুন্তি বা পৃথার পুত্র। এই পৃথা হলো পৃথিবীর প্রতীক। এবং প্রত্যেকেরই জন্মদাতা কোন না কোনো দেবতা।তার মানেটা কি দাঁড়ায় ? পাঁচ ইন্দ্রিয় তথা পঞ্চপ্রাণ জন্ম নেয় পৃথিবী ও দেবতার মিলনের ফলে। অর্থাত মাটি থেকে পাওয়া দেহ এবং তার ভিতরে পরমাত্মা থেকে জন্ম নেয়া জীবাত্মা যখন একত্র হয় তখনই পঞ্চপ্রাণ তথা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের জন্ম।   
    এরপর আসি কৌরবদের কথায়। পান্ডবদের সাথে কৌরবদের সবসময়ে বিরোধ।এই কৌরবদের সংখ্যা ১০০ ।  ১০০ কৌরব হচ্ছে মনের প্রবণতা যা শতধা বিভক্ত।মহাভারতে আছে - যুধিষ্ঠির ছিলেন পাশা খেলায় দক্ষ। তিনি ভাবতেন - তিনি পাশা খেলে কৌরবদের পরাস্ত করতে পারবেন। ঠিক যেমনভাবে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি  মনের নানারকম প্রবণতার সাথে জুয়া খেলে জিততে চায়। কিন্তু সেই জুয়া তাকে পতনের দিকেই নিয়ে যায়। ঠিক যেমন পান্ডবরা এই জুয়ার ফলেই জীবনের সবকিছু সুখ হারিয়ে বাধ্য হয়েছে বনবাসে যেতে। 
   
    এবার আসা যাক ধৃতরাষ্ট্রের প্রসঙ্গে।ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ তার সন্তানদের স্নেহে। ধৃতরাষ্ট্র হল আমাদের মনের প্রতীক। মনের সন্তান হল সকল প্রবণতা। অর্থাত আমাদের মন সবসময়ে নিজ প্রবণতার প্রতি অপত্যস্নেহে ডুবে থাকে। গান্ধারী হল অন্ধভাবে মনকে অনুসরণ করার প্রতীক। আমরা অনেকসময়েই জানি - কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা তবু আমরা চোখ বন্ধ করে রাখি এবং অন্যায়কে মেনে নেই। আমাদের সেই ভাবের প্রতীক হল গান্ধারী। আর মন যখন নিজের প্রবনতার প্রতি অন্ধ থাকে এবং নিজের বোধ বুদ্ধি থাকলেও নিজের দৃষ্টিকে আবৃত রাখে তখনই মনের এই আপোষমূলক মনোভাবের প্রতীকের ভাই  সর্বনাশের আবির্ভাব হয়। ঠিক যেমন মহাভারতে এভাবেই গান্ধারীর ভাই শকুনীর প্রবেশ ঘটেছিল।এই শকুনী হল মনের ভিতরের সেই কুটিল ভাবের প্রতীক যা আমাদের মনে আসে যখন মন বিবেচনা শক্তি হারিয়ে সবকিছুর সাথে আপোষ করতে চায়। আর এই কুটিল ভাব মানুষের মনের সকল শান্তি নষ্ট করে তাকে নিয়ে যায় সর্বনাশের পথে।

 কৌরব আর পান্ডবদের মাঝে রয়েছেন কর্ণ। মহাভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এই কর্ণ হলেন ইগো বা অহমিকার প্রতীক। তার রয়েছে কবচ কুণ্ডল যার ফলে তিনি অবধ্য।আমাদের এই ইগোও অবোধ্য। তাকে বধ করতে না পারলে জীবনের যুদ্ধে জয় অসম্ভব। তাকে বধ করতে হলে এই কবচ কুণ্ডল কেড়ে নিতে হয়। একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই পারেন সেই কবচ কুণ্ডল কেড়ে নিতে।অর্থাত আত্মা যখন বিবেককে গুরু করে এই অহমিকার কবচ কুণ্ডল কেড়ে নেয় তখনি ইগোকে বোধ করা সম্ভব। যেমন মহাভারতে পান্ডবদের জয়ের শেষ বড় কাঁটা ছিলেন কর্ণ তেমনি জীবের মুক্তির সবচেয়ে বড় কাঁটা এই ইগো। এর বধ একান্ত প্রয়োজন। 
   
   পান্ডবদের বনবাসের শেষে এল কুরুক্ষেত্র। কুরুক্ষেত্র কি? যে জগতে আমরা রয়েছি সেই হল কুরুক্ষেত্র।এই কুরুক্ষেত্র হল সেই জগত যেখানে নিয়ত চলছে ইন্দ্রিয় এবং মনের শতধা বিভক্ত প্রবণতার মধ্যে যুদ্ধ।  এখানে সমানে ভালো এবং মন্দের লড়াই চলে। এখানে পান্ডবপক্ষের পরামর্শদাতা শ্রীকৃষ্ণ পরামর্শ দিচ্ছেন অর্জুনকে বিপক্ষের ভালো মন্দ সবাইকে বধ করতে। কৌরবপক্ষে ভালো মন্দ দুই ছিল। কিন্তু তাও কৃষ্ণ তাদের সবাইকেই বধ করতে বলেছেন। কারণ - সকল প্রকার প্রবণতাই বধ করতে হয় মনকে নির্বিকল্প সমাধীর স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।তাই যেসব অসত প্রবণতা বা শুভ প্রবণতা মনে জাগে সবেরই বধ আশু প্রয়োজন। যথার্থ জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে গেলে ভালো মন্দ দুইকেই পেরিয়ে যেতে হবে। গীতায় শ্রী কৃষ্ণ বলছেন - এখানে শত্রু মিত্র কারোরই কোন অস্তিত্ব নেই। তুমি এদের কি বধ করবে?আগে থেকেই এরা বধ হয়ে আছে। তুমি নিমিত্ত হও।খানে প্রবণতাগুলির কোন অস্তিত্ব নেই। আমরা এদের যেভাবে জন্ম দিই এরা সেভাবেই বড় হয়। এরা মূলত মৃত। সব প্রবণতা অস্তিত্বহীন।এদের আমরা বাঁচিয়ে রাখি আমাদের কর্মের দ্বারা। মুক্তি পেতে গেলে এই সব প্রবণতা বধ করতে হবে। 

  লেখাটি ক্রমশ বড় হয়ে যাচ্ছে। তাই শ্রীকৃষ্ণের প্রসঙ্গ টেনেই আজকের মত ব্লগ শেষ করছি। শ্রী কৃষ্ণ হলেন জীবাত্মার প্রতীক যিনি পরমাত্মার অংশ । তাঁর গায়ের রং ঘন নীল যা অনন্তের প্রতীক যেমন নীল আকাশ বা নীল সমুদ্র। তাঁর জ্ঞান হল অনন্ত।তাঁর লীলাও অসীম। তিনি পীতাম্বর।হলুদ বস্ত্র পরেন। এই হলুদ হল পৃথিবীর প্রতীক। অর্থাত অসীম অনন্ত পরমাত্মার প্রতীক পার্থিব দেহ ধারণ করে এসেছেন। অর্থাত বাইরে পার্থিব দেহ,ভিতরে অনন্ত আত্মা। শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতের যুদ্ধে ছিলেন দ্রষ্টা। জীবাত্মাও দ্রষ্টা। কিন্তু বিবেকের রূপে তিনি তার বাণী শুনিয়ে দেন পঞ্চপ্রাণ তথা পঞ্চইন্দ্রিয়কে। সেই কথা শুনে তারা যদি তাঁর কথা মেনে নেয় তবেই জয়যুক্ত হয় জীবনের কুরুক্ষেত্রে। পান্ডবদের জয় সেই রূপক বহন করছে।  

No comments:

Post a Comment