Ami Tarashis Bolchi

Ami Tarashis Bolchi
The blog of Tarashis Gangopadhyay (click the photo to reach our website)

Thursday 25 April 2024

তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা "মহাপ্রভুর নীলাচলে আজও চলে লীলা" বইটি থেকে মহাপ্রভুর অন্তর্ধান বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের একটি ভাগ আমাদের পাঠক বন্ধুদের জন্যে তুলে দেয়া হল

#জয়_মা_তারা_পাবলিশার্স 

আমাদের জয় মা তারা পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত
লেখক তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা "মহাপ্রভুর নীলাচলে আজও চলে লীলা" বইটি থেকে  মহাপ্রভুর অন্তর্ধান বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের একটি ভাগ আমাদের পাঠক বন্ধুদের জন্যে তুলে দেয়া হল।

---------------------------------------

সমুদ্রের বুক থেকে অনাবিল বাতাস ভেসে আসছে। সামুদ্রিক বাতাসের শীতল নোনা স্পর্শে জুড়িয়ে যাচ্ছে মনপ্রাণ। কিন্তু মুখর ব্রহ্ম সাগরের সামনে বসে বেশীক্ষণ তো মৌন থাকা যায় না। আর মধুপর্ণা তেমন পাত্রীও নয়। অতএব ব্যালকনিতে এসে বসতে না বসতেই সে উত্থাপন করল আলোচনার প্রসঙ্গ, “আচ্ছা দাদা, দুপুরবেলায় তো বলছিলে যে সন্ধ্যায় বালানন্দ তীর্থাশ্রমে ফিরে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্দ্ধান নিয়ে তোমার বিশ্লেষণের কথা বলবে। তা এখন কি ওই বিষয়টা নিয়ে একটু আলোচনা করা যায়?"

আমি বলি, "কেন যাবে না? এসব আলোচনা করার মত আদর্শ পরিবেশেই তো বর্তমানে আছি। আশেপাশে কোন লোকজনও নেই। তাই সুজয়েরও দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার কারণ নেই।” বলতে বলতেই সুজয়ের দিকে চাই আমি, "কি ভাই, ঠিক বললাম তো?”

সুজয় হাসে, "আসলে কি জানো - পুরীতে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্দ্ধান রহস্যের বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর বিষয় বলেই মানা হয়। আর তাই উন্মুক্ত সড়কে এই রহস্য নিয়ে মুক্তকণ্ঠে আলোচনা করতে গেলে প্রাণ নিয়ে টানাটানি হতে পারে। অতীতে পুরীধামে বসে এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে গবেষক লেখক ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায় তো অজানা আততায়ীদের হাতে খুন হয়েছিলেন। তাঁর বৃদ্ধা মাও তাদের আক্রমণে আহত হয়েছিলেন। আমি চাইনি তখন প্রকাশ্য রাজপথে এই বিষয়ে আলোচনা করে আমাদের ক্ষেত্রে সেই 
ঘটনার পুনরাবৃত্তির কোন সামান্যতম সম্ভাবনাও দেখা দিক। তবে বর্তমানে এখানে বসে নিরিবিলিতে সেই আলোচনা তো করাই যেতে পারে।"

আমি বলি, “ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের কথা আমিও জানি। তিনি যে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্দ্ধান রহস্য নিয়ে গবেষণা করতে করতে অনেকটা গভীরে চলে গিয়েছিলেন তা আমারও অজানা নয়। তাঁর 'কাঁহা গেলে তোমা পাই' গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে উপন্যাসের আড়ালে তিনি তাঁর সেই গবেষণাই তুলে ধরেছিলেন। ১৯৭৭ সালে সেটি প্রথম প্রকাশিত হয় 'ঝাড়গ্রাম বার্তা'-য়। গ্রন্থটি যেখানে তিনি শেষ করেছিলেন তাতে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে আর দুটো প্রমাণ পেলেই তিনি ঘোষণা করবেন কারা সেদিন শ্রীচৈতন্যদেবকে হত্যা করেছিলেন এবং কোথায় সমাহিত করা হয়েছে তাঁর মরদেহ। অর্থাৎ 'কাঁহা গেলে তোমা পাই'-এর দ্বিতীয় খণ্ডেই তিনি সবকিছু জানাবেন। কিন্তু কোন অজানা কারণে দ্বিতীয় খণ্ডটি পরবর্ত্তী আঠেরো বছরের মধ্যে আর প্রকাশিত হয়নি এবং ১৯৯৫ সালে তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হন। তাই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল যে প্রথম খণ্ড বেরোনোর পরও তিনি তো আঠেরো বছর জীবিত ছিলেন। এর মধ্যে পরের খণ্ডটি তিনি প্রকাশ করলেন না কেন? এ বিষয়ে 'কাঁহা গেলে তোমা পাই' গ্রন্থের প্রকাশক প্রাচী পাবলিকেশনের কর্ণধার জয়দীপবাবুকেও আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায় দ্বিতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপিও প্রস্তুত করেছিলেন যথাযথ প্রমাণসহ। কিন্তু সেটি প্রকাশ করার আগেই অজানা আততায়ীর হাতে তিনি নির্মমভাবে খুন হন এই পুরীধামেই। আর তখনই খোয়া যায় পাণ্ডুলিপিসহ সব প্রমাণ। অতএব এই বিষয়টি নিয়ে পুরীধামের প্রকাশ্য রাজপথে কথা বলতে না দিয়ে ভালই করেছ তুমি।"

আমার সমর্থন পেয়ে খুশী হয় সুজয়। তবে মধুপর্ণা প্রশ্ন তোলে, "কিন্তু ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা তো নিশ্চয়ই মানুষকে সত্যেরই পথ দেখাত। যে মহাপ্রভুর প্রেমের জোয়ারে বাংলা ও উড়িষ্যার বুকে হল ভক্তির নবজাগরণ সেই প্রেমাবতারের স্থূলদেহের অন্তর্দ্ধান রহস্য সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ও অধিকার তো প্রতিটি মানুষেরই আছে। তাহলে যে গবেষক সেই সত্যসন্ধানে অগ্রসর হয়েছিলেন তাঁকে এভাবে হত্যা করার কারণ কি?”

সুজয় বলে, "ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের গবেষণায় যে মৌচাকে ঢিল পড়েছিল। মৌচাকে ঢিল পড়লে কি আর মৌমাছিরা চুপ করে থাকে?"

-"কিন্তু ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায় যে সময়ে এই গবেষণা করছিলেন তখন থেকে প্রায় ৪৫০ বছর আগের একটি রহস্যের উপর আলোকপাত হলে কার কি আসত যেত?” 

  -"কারো যে আসত যেত তাতো বলাই বাহুল্য। নাহলে কেনই বা তাঁর দ্বিতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপি চুরি যাবে? আর কেনই বা তিনি অকালে খুন হবেন?"

-"কিন্তু তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী কারা? কারা তাঁকে এভাবে হত্যা করল?"

-"তার কোন সদুত্তর নেই। আর যখন কোন হত্যাকাণ্ডের সদুত্তর পাওয়া যায় না তখন কাউকে এ বিষয়ে দোষী সাব্যস্ত করাও ঠিক নয়। তবে সন্দেহের তীরটা যায় সেইসব মানুষের বংশধরদের দিকে যাঁরা একদিন আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্যদেবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে শোনা যায় পুরীর একটা সম্প্রদায় এখনো এ বিষয়ে গবেষণা অপছন্দ করে। আর তাই কেউ এ বিষয়ে গবেষণা করতে গেলে তাদের প্রাণে মেরে ফেলতেও দ্বিধা বোধ করে না। সেজন্যই ডঃ নীহাররঞ্জন রায় বলেছিলেন, 'শ্রীচৈতন্যের দেহাবসান কিভাবে ঘটেছিল সে সম্বন্ধে আমার কিছু যুক্তিনির্ভর ধারণা আছে। কিন্তু সে ধারণাটি আমি প্রকাশ্যে বলতে বা লিখতে পারব না ; যদি বলি বা লিখি বঙ্গদেশে প্রাণ নিয়ে বাঁচতে পারব না। অতএব ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের অকালমৃত্যু কেন হয়েছিল তা তো আন্দাজ করতেই পারছ।"

-"তাহলে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্দ্ধান রহস্য নিয়ে গবেষণাই তাঁর অকালমৃত্যুর কারণ! কিন্তু প্রশ্ন হল শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্দ্ধান রহস্য কি উদ্‌ঘাটন করা একেবারেই অসম্ভব? এই সত্যান্বেষণ কি কোনদিনই সম্ভব হবে না?"

সুজয় এবার রণে ভঙ্গ দিয়ে আমার দিকে চায়। অতএব আমি মৃদু হেসে মধুপর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, "আমার প্রিয় বোনটি, এপ্রসঙ্গে প্রথমেই বলি সত্যান্বেষণের প্রথম শর্তই হল যে আগে ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে বুঝতে হবে সেটি আদৌ অপরাধ না দুর্ঘটনা। যদি ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এটি অপরাধ তখন দেখতে হবে এর মধ্য থেকে কি সূত্র পাওয়া যায়। সেই সূত্র ধরে বের করতে হয় অপরাধীর মোটিভ। একমাত্র তারপরই আসা যায় উপসংহারে।"

মধুপর্ণা বলে, "তবে ঘটনার গতিপ্রকৃতি একটু বিশ্লেষণ করেই বল না কেন! সত্যান্বেষীর মগজাস্ত্র একটু চালনা নাহয় করলে তোমার বোনটির জন্য! দেখাই যাক না রহস্য উদ্‌ঘাটনের কতটা কাছে পৌঁছনো যায়?"

সুজয় হাসে, "আর এতো তোমার যে সে বোন নয়। রীতিমত বন্য বোন। অনুরোধ করলেও সেটা আদেশেরই নামান্তর হয়ে ওঠে।"

আমিও হাসি সুজয়ের কথায়। বলি, "বোনেরা একটু এমনটিই হয়। আর তাদের সাথে বনিবনা ঠিক রাখতে গেলে তাদের আবদারও রাখতেই হয়। সে আবদার যতই 'বন্য' হোক না কেন তাকে 'বোন্য' বলেই সম্মান দিতে হয়।" তারপর বোনের আবদার রাখার কাজ শুরু করি। মধুপর্ণাকে জিজ্ঞাসা করি, "আচ্ছা বল তো, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধান প্রসঙ্গে সকলে কি বলে থাকেন?"

মধুপর্ণা বলে, "সকলে তো বলেন তিনি জগন্নাথদেবের মধ্যে লীন হয়ে গেছেন। কিন্তু তাই কি কখনো হতে পারে? কারোর স্থূলদেহ কি কখনো বিগ্রহের মধ্যে লীন হয়ে যেতে পারে?"

আমি বলি, "হতে পারে না বলে কিছুই নেই এই পৃথিবীতে। যোগশক্তিতে সকলই সম্ভব। জীবনে আমি যত অলৌকিক লীলা প্রত্যক্ষ করেছি তাতে আমি নিশ্চিত যে প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্যদেব যদি তেমনটিই চাইতেন তবে তাও করতে পারতেন। অবতারের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু তিনি যদি তেমনটাই চাইতেন তবে তিনি ভক্তদের সেই ইঙ্গিত দিয়ে যেতেন এবং তাঁর ভক্তরাও তাঁদের প্রাণপ্রিয় মহাপ্রভুর সেই ইঙ্গিত লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। কিন্তু বৈষ্ণব কবিদের রচনায় তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। আর তাছাড়া এটাও দেখা গেছে যে অবতার এবং অবতারবরিষ্ঠ মহাত্মারা পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলে নিজে সবকিছুর অতীত হওয়া সত্ত্বেও জন্ম-মৃত্যুসহ গ্রহদের সকল বিধানই মাথা পেতে নেন এবং স্বাভাবিক নিয়মেই দেহত্যাগ করেন। স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামকৃষ্ণদেব এর উদাহরণ। এই শ্রীকৃষ্ণের কথাই ধর না কেন! ভেবে দ্যাখো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণের মত মহারথীদের হাজার হাজার বাণ যে শ্রীকৃষ্ণের দেহে বিদ্ধ হওয়াসত্ত্বেও তাঁর কোন ক্ষতি হয়নি সেই শ্রীকৃষ্ণই জরা ব্যাধের মত সামান্য এক ব্যাধের তীরের আঘাতে প্রাণত্যাগ করেছেন। এর অর্থ কি? পৃথিবীতে নির্দিষ্ট সময়ের লীলাখেলা শেষ হলে একটি ছুতোর প্রয়োজন হয় যেটিকে মাধ্যম করে অবতার দেহ রেখে ফিরে যান অমৃতলোকে। অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়মমত প্রকৃতির দেহ ত্যাগ করে স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুকে মেনে নেন সকল অবতার। মর্য্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র, লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ, শিবাবতার বামাক্ষ্যাপা, সচল শিব ত্রৈলঙ্গস্বামী, যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ প্রভৃতি সবাই মেনেছেন প্রকৃতির নিয়ম। তাই শ্রীচৈতন্যদেবই বা ব্যতিক্রম হতে যাবেন কেন? দেহ তো আত্মার কর্মভূমিমাত্র। একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এতে আবির্ভূত হয়ে লোককল্যাণের কাজ করেন অবতার আর তারপর কাজের সময় অতিক্রান্ত হলে মাটির দেহ মাটিতেই ফিরিয়ে দিয়ে তিনি চলে যান তাঁর জন্য নির্দিষ্ট লোকে। তাই আমার বিশ্বাস শ্রীচৈতন্যদেবও প্রকৃতির সেই বিধান লঙ্ঘন করেননি।”

-"তাহলে বৈষ্ণব কবিরা কেন বলে আসছেন যে মহাপ্রভু 'জগন্নাথ অঙ্গে লীন' হয়ে গেছেন?"

আমি বলি, "এইমাত্র তুমি যে তত্ত্বটি বললে মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধান রহস্যের আলোচনায় ওটিই হচ্ছে মূল সূত্র। আর এই সূত্র ধরেই আমরা এগোব রহস্যের কিনারার দিকে।"

সুজয় অবাক হয়, "তার মানে?

আমি বলি, "মানেটা খুব সহজ। কিন্তু সেটা এখনই বলব না। বলব ঘটনাটি বিশ্লেষণ করার পর। তাহলে আমার সাথে সাথে তোমাদেরও মগজাস্ত্র সেদিকে চালনা করতে সুবিধা হবে। তাই প্রথমেই আসা যাক ঘটনার বিশ্লেষণে। দেখা যাক শ্রীচৈতন্যদেব কিভাবে লীন হয়ে গিয়েছিলেন জগন্নাথদেবের বিগ্রহের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে তাঁর ঠিক সমসাময়িক ভক্তরা কিন্তু মুখ খোলেননি। যদিও অনেকেই চৈতন্য-জীবনী লিখেছেন কিন্তু শ্রীচৈতন্যলীলার সবকিছু সুচারুভাবে বর্ণনা করলেও তাঁর দেহরক্ষার প্রসঙ্গে এসে তাঁরা দুয়েক লাইনে উপসংহার টেনেছেন। মুরারী গুপ্তের কড়চা তার অনুপম নিদর্শন। তারপর আসা যাক কৃষ্ণদাস কবিরাজের কথায়। তিনি তাঁর 'চৈতন্য চরিতামৃত' গ্রন্থে অন্তঃলীলার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিলেও মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধান প্রসঙ্গে নীরবতা বজায় রেখে উপসংহারে লিখেছেন

'শেষ লীলার সূত্রগণ
    কইল কিছু বিবরণ
   ইহা বিস্তারিতে চিত্ত হয়।     থাকে যদি আয়ুঃশেষ
 বিস্তারিব লীলাশেষ
  যদি মহাপ্রভুর কৃপা হয়।'

অর্থাৎ এখানেও যে সব বলা হয়নি তা স্বীকার করে নিয়েছেন ভক্তপ্রবর কৃষ্ণদাস কবিরাজ। তাঁর তথা অন্য গৌড়ীয় বৈষ্ণব কবিদের এই অন্তর্দ্ধান লীলার বিষয়ে এহেন তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে মহাপ্রভুকে ওখানেই পাণ্ডারা গুম-খুন করেছে তবে তাঁর মরদেহ গেল কোথায়? অত সত্বর তো তাঁর দেহ সমাহিত করা সম্ভব নয়। বিশেষতঃ বাইরে যখন দাঁড়িয়ে আছে তাঁর অগণিত ভক্ত। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে লোচনদাসকে এমন একটি অবিশ্বাস্য তত্ত্ব কেন লিখতে বলা হল? তবে কি নরহরি ঠাকুর এই ঘটনার মধ্য দিয়ে কোন তাত্ত্বিক ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন যা সেইসময়ে যথাযথভাবে প্রকাশ করা সম্ভব না হলেও যাতে পরবর্তীকালে সেই ইঙ্গিতটিকে সূত্র হিসেবে নিয়ে তদন্ত করা হয়? তাহলে সেই ইঙ্গিত কি? তবে কি তিনি রহস্যের মাধ্যমে বলতে চাইছেন যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর এই অন্তর্দ্ধান লীলা একমাত্র পাণ্ডারাই জানেন এবং তাঁরাই ঘোষণা করেছেন এহেন সিদ্ধান্ত?" এই পর্যন্ত বলে আমি থামলাম।

মধুপর্ণা বলে, “বেশ ইন্টারেস্টিং বিষয় তো! তাহলে লোচনদাসের কাহিনীটিকে একটি সূত্র হিসেবেই ধরতে হবে?"

আমি বলি, "অবশ্যই। তার পরের সূত্র দিচ্ছেন জয়ানন্দ। তাঁর 'চৈতন্যমঙ্গল'-এ কিন্তু বদলে গেছে মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধানস্থল। তিনি লিখেছেন - মহাপ্রভু দেহরক্ষা করেছেন গদাধর পণ্ডিতের সাধনক্ষেত্র তোটা গোপীনাথে। এবার তাঁর রচনা পর্যালোচনা করে দেখা যাক। তিনি লিখছেন-
 'আষাঢ় বঞ্চিতা রথ বিজয় নাচিতে।
  ইঁটাল বাজিল বাম পায়ে আচম্বিতে।।
  ...চরণে বেদনা বড় ষষ্ঠীর দিবসে।
  সেই লক্ষ্যে তোটায় শয়ন অবশেষে।।
   পণ্ডিত গোসাঞিকে কহিল সর্বকথা।
  কালি দশ দণ্ড রাত্রে চলিব সর্বথা।।
  মায়া শরীর তথা থাকিল ভূমে পড়ি।
   চৈতন্য বৈকুণ্ঠ গেলা জম্বুদ্বীপ ছাড়ি।।'

অর্থাৎ জয়ানন্দের 'চৈতন্যমঙ্গল' বলছে আষাঢ় মাসের পঞ্চমীতে রথযাত্রার সময়ে ভাবাবেশে নাচতে নাচতে মহাপ্রভুর বাঁ পা গিয়ে পড়ে ইঁটের উপরে। সেই ইঁটের ঘায়ে যে ক্ষত হয় সেই ক্ষত অচিরেই বিষিয়ে ওঠে পরদিন ষষ্ঠীতে। সেই বাঁ পায়ের ক্ষত বিষাক্ত হয়ে ওঠায় তাঁর শরীরে বাসা বাঁধে সেপটিক জ্বর। সেইসময়ে শ্রীচৈতন্যদেবের পরম ভক্ত গদাধর পণ্ডিত তাঁকে নিয়ে আসেন তোটা গোপীনাথের মন্দিরে। সেখানে মহাপ্রভু দেহরক্ষা করেন। জয়ানন্দের এই তত্ত্বটি পরবর্ত্তীকালে সমর্থন করেছেন নিত্যানন্দবংশীয় শ্যামলাল গোস্বামী। তিনি লিখেছেন- 'একদিন রথাগ্রে নৃত্য করিতে করিতে প্রভুর পদনখে আঘাত লাগিল। উক্ত আঘাতকে ছল করিয়া প্রভু লোকলীলা সংবরণের অভিলাষ করিলেন।' 
     নরহরি চক্রবর্ত্তির 'ভক্তিরত্নাকর' গ্রন্থেও লেখা আছে-
  'ওহে নরোত্তম এই স্থানে গৌরহরি।
  না জানি পণ্ডিতে কি কহিল ধীরি ধীরি।।
  প্রবেশিলা এই গোপীনাথের মন্দিরে।
  হৈলা অদর্শন পুনঃ না আইলা বাহিরে।।

ওড়িয়া কবি সদানন্দ কবিসূর্য্য ব্রহ্মও তাঁর 'প্রেমতরঙ্গিনী' কাব্যে মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধানের বিষয়ে লিখেছেন -
  'অষ্ট চালিশ বরষে অন্তর্দ্ধান টোটা গোপীনাথ স্থানে।'

  কিন্তু তৎকালীন বৈষ্ণব সমাজ এই মতটিকে গ্রহণ করেননি। ইতিহাসবিদরা বলে থাকেন যেহেতু অবতারের লৌকিক মৃত্যু হলে তাঁর মহিমা ক্ষুন্ন হয় সেজন্যই এই মত তাঁরা মানেননি। কিন্তু আমি বলব মহামতি বৈষ্ণব আচার্য্যরা এই মত গ্রহণ করেননি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। যাঁদের উপাস্য স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ লৌকিক জগৎ থেকে অন্তর্দ্ধানের জন্য লৌকিক মৃত্যু বরণ করেছেন তাঁরা শ্রীচৈতন্যদেবের ক্ষেত্রেও এমনটিই হয়ে থাকলে মানবেন না কেন? আসলে এই মতটি যে একান্তই অবিশ্বাস্য। যে মহাপ্রভুর একান্ত ভক্ত রাজা প্রতাপরুদ্র, মন্ত্রী রামানন্দ, রাজগুরু কাশী মিশ্র, সভাপণ্ডিত সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য সেই মহাপ্রভু পঞ্চমীতে আহত হয়ে ষষ্ঠীতে ভুগে সপ্তমীতে বিনা চিকিৎসায় দেহরক্ষা করবেন এটা একান্তই হাস্যকর তথ্য। যদি সত্যিই তেমনটি হত তবে রাজা প্রতাপরুদ্রসহ অন্য শীর্ষস্থানীয় ভক্তরা মহাপ্রভুর জন্য উড়িষ্যার কবিরাজ চিকিৎসকদের ভিড় করে আনতেন তোটায়। কিন্তু তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না কোন বৈষ্ণব কবির রচনায়। অতএব সঙ্গত কারণেই এই মতটিকে বৈষ্ণব আচার্য্যরা মেনে নেননি।"

সুজয় বলে, "কিন্তু আমি শুনেছিলাম মহাত্মা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বলেছেন যে মহাপ্রভু দেহত্যাগের পূর্বে তোটা গোপীনাথের মধ্যে শক্তিসঞ্চার করে দিয়ে তাঁর মধ্যেই প্রবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন এবং মহাপ্রভুর তোটা গোপীনাথের মধ্যে প্রবেশ করার পর থেকে তোটা গোপীনাথের উরুতে একটি সুবর্ণচিহ্নও দেখা যায়। সে প্রসঙ্গে কি বলবে?"

আমি বলি, "দ্যাখো, গোস্বামীপ্রভু কিন্তু ছিলেন মহাপ্রভুরই নব কলেবরস্বরূপ। তাই তাঁর মত অবশ্যই শ্রদ্ধার সাথে বিচার করা উচিত। কিন্তু মহাত্মাদের সকল কথার ব্যাখ্যা তো অত সহজে করা যায় না। তাঁদের বক্তব্যে সরল অর্থের চেয়ে নিহিতার্থ যে বেশী প্রাধান্য পায়। তাই তাঁর কথার ব্যাখ্যা আরেক ভাবেও করা যায়। শ্রীকৃষ্ণের প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু উপলব্ধি করেছিলেন যে তাঁর লীলাশেষের কাল সমাগত। হয়তো তাই দেহরক্ষা করার আগে নিজের সকল শক্তি সঞ্চার করে দিয়েছিলেন তোটা গোপীনাথের মধ্যে। কারণ তাঁর অপ্রাকৃত শক্তি ধারণ করার ক্ষমতা অন্য মানুষের ছিল না। তোটা গোপীনাথের উরুর ওই সুবর্ণচিহ্ন নির্ঘাৎ সেই শক্তি সঞ্চারেরই প্রমাণ। গোস্বামীপ্রভু তোটা গোপীনাথের মধ্যে প্রবিষ্ট হওয়ার কথাও বলেছেন। আর আমি শুনেছি তোটা গোপীনাথের ঠিক নীচ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ ছিল সাগর অবধি যা পরবর্তীকালে বুজিয়ে দেয়া হয়। এমনও তো হতে পারে যে মহাপ্রভু সেই সুড়ঙ্গপথেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন তোটা গোপীনাথের মধ্যে শক্তি সঞ্চার করার পর। তাই কেউ আর তাঁকে তোটা গোপীনাথ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেননি। মনে করে দ্যাখো দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণও সকল কর্ম শেষ করে নিয়তিকে বরণ করে নেয়ার জন্য শান্তভাবে জরা ব্যাধের জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন প্রভাসের অরণ্যে। ঠিক তেমনিভাবেই হয়তো মহাপ্রভুও তাঁর সকল শক্তি তোটা গোপীনাথের মধ্যে সঞ্চার করে দিয়ে নিজের ভবিতব্যকে বরণ করতে চলে গেছেন জগন্নাথ মন্দিরে।"

মধুপর্ণা জিজ্ঞাসা করে, "তাহলে কি জগন্নাথ মন্দিরেই তিনি দেহরক্ষা করেছিলেন?"

আমি বলি, "জাগতিক দৃষ্টিতে দেখলে তেমনটাই তো ইঙ্গিত করছে অন্য সকল সূত্র।” 

সুজয় বলে, "কিভাবে?”

আমি বলি, "এ প্রসঙ্গেও অনেকগুলি মত আমরা পাই। প্রথমেই বলি শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ওড়িয়া শিষ্য অচ্যুতানন্দের কথা। তিনি তাঁর 'শূন্যসংহিতা' গ্রন্থে লিখেছেন

'চৈতন্যঠাকুর মহানৃত্যকার রাধা রাধা ধ্বনি কলে।     জগন্নাথ মহাপ্রভু শ্রীঅঙ্গে বিদ্যুন্ প্রায় মিশি গলে।।' 

অর্থাৎ- তিনি জগন্নাথ মন্দিরে 'রাধা রাধা' ধ্বনি দিতে দিতে বিদ্যুতের মত অন্তর্হিত হয়ে যান শ্রীঅঙ্গে।

 বিশিষ্ট ভক্ত কবি ঈশান নাগর আবার তাঁর 'অদ্বৈতপ্রকাশ' গ্রন্থে লিখেছেন

'একদিন গোরা জগন্নাথে নিরখিয়া।
 শ্রীমন্দিরে প্রবেশিল 'হা নাথ' বলিয়া।। 
প্রবেশমাত্রে দ্বার স্বয়ং রুদ্ধ হৈল। 
ভক্তগণ মনে বহু আশংকা জন্মিল।।
 কিছুকাল পরে স্বয়ং কপাট খুলিল।
  গৌরাঙ্গাপ্রকট সবে অনুমান কৈল।।' 
অর্থাৎ- সেদিন মহাপ্রভু জগন্নাথ দর্শনের জন্য মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করামাত্র মন্দিরের দ্বার বন্ধ হয়ে যায়। ভক্তরা নানা আশংকা করতে থাকেন। মন্দিরের দ্বার যখন পুনরায় খুলল তখন দেখা গেল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অপ্রকট হয়েছেন। এই ব্যাখ্যাটি কিন্তু বেশ যুক্তিযুক্ত।

'জগন্নাথ চরিতামৃত' কাব্যে দিবাকর দাসও লিখেছেন যে মহাপ্রভু সবার অলক্ষ্যে 'শ্রীজগন্নাথ অঙ্গে লীন' হয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যে উৎস থেকে ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন অন্তিমে সেই জগন্নাথদেবের মধ্যেই ফিরে গিয়েছেন। 

এ প্রসঙ্গে 'শ্রীচৈতন্যভাগবত' গ্রন্থে ঈশ্বরদাস লিখছেন ভাবাবিষ্ট শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জগন্নাথদেবকে চন্দন পরানোর সময়ে প্রীত হয়ে জগন্নাথদেব মুখ বিস্তৃত করেন। তৎক্ষণাৎ মহাপ্রভুর হাত থেকে চন্দনপাত্র পড়ে যায় এবং তিনি জগন্নাথদেবের বিস্তৃত মুখগহ্বরে প্রবেশ করে লীন হয়ে যান বিগ্রহগর্ভে। এই মতটি অবশ্য বিশেষ বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। তাই পরবর্তীকালে মহাপ্রভুর সন্ন্যাসী পার্ষদ বাসুদেব তীর্থ এ বিষয়ে ঈশ্বরদাসকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন; জানতে চেয়েছিলেন যে কেন তিনি এমনধারা কথা লিখেছেন। উত্তরে ঈশ্বরদাস বলেছিলেন যে তিনি যা লিখেছেন তা তাঁর গুরুর আদেশেই লিখেছেন। তিনি আরো বলেছিলেন যে এক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্যের আক্ষরিক অর্থের পরিবর্তে তাত্ত্বিক অর্থটিই ধরতে হবে। সেই তাত্ত্বিক অর্থটা বুঝতে ভুল হওয়ার নয় -ভাবাবিষ্ট শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জগন্নাথদেবের মধ্যে লীন হয়ে গেছেন।

অতঃপর আসি বৈষ্ণবদাসের বক্তব্যে। তিনি তাঁর 'চৈতন্য চকড়া' গ্রন্থে লিখেছেন যে পূর্ণিমা তিথিতে জগন্নাথ মন্দিরে মহাপ্রভুর দেহপাত হয় 
 'রাত্র দশ দণ্ডে চন্দন বিজয় যখন হল।।
  তখন পড়িলা প্রভুর অঙ্গ স্তম্ভ পছ আড়ে।
  কান্দিল বৈষ্ণবগণ কুহাতো কুহাড়ে।।'

অর্থাৎ আষাঢ়মাসের পূর্ণিমার রাতে জগন্নাথ মন্দিরে যখন জগন্নাথদেবের চন্দন সেবন হচ্ছিল তখনই গরুড়স্তম্ভের পিছনে ভাবাবিষ্ট অবস্থায় শ্রীচৈতন্যদেবের দেহ পড়ে যায়। অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জগন্নাথ অঙ্গে লীন হওয়ার
ব্যাখ্যাটিই সবাই গ্রহণ করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল- এই জগন্নাথ অঙ্গে লীন হওয়াটা কি কোন সূত্র? অধিকাংশ ভক্তই তো এদিকেই নির্দেশ করছেন। তার অর্থ এমনো হতে পারে যে তখন বৈষ্ণব আচার্য্যরা যে বক্তব্য সরাসরি বলে যেতে পারেননি তা পরবর্তীকালের গবেষকদের সুবিধার জন্য হয়তো সাংকেতিকভাবে বলে গেছেন এই বাক্যের মাধ্যমে। কারণ সকলেই মানেন যে অবতার যখন লৌকিক দেহ ধারণ করে ধরায় অবতীর্ণ হন তখন লৌকিক উপায়েই তাঁরা এই নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন। তাহলে প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্যদেব জগন্নাথদেবের মধ্যে লীন হয়ে গেলেও তাঁর স্থূলদেহটি পাওয়া গেল না কেন? তবে কি স্থূলদেহটির এমন কোন অমর্য্যাদা করা হয়েছিল যা ভক্তসমক্ষে এলে পুরীতে জ্বলে যেত বিদ্রোহের আগুন? এর থেকে তো একটাই উপসংহারে আসা যায়- শ্রীচৈতন্যদেবের স্বাভাবিক দেহরক্ষা হয়নি। আর মহাপ্রভুকে যদি আদৌ হত্যা করা হয়ে থাকে তবে সেটির জন্য জগন্নাথ মন্দিরই যে আদর্শ স্থান সেটিও বলাই বাহুল্য। কারণ এই মন্দিরে এমন কিছু রন্ধ্র আছে যেখানে কাউকে যদি সমাধি দেয়া হয় তবে তাঁর মরদেহ কোনদিন খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না। আর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যদি সজ্ঞানেই নিজেকে জগন্নাথদেবের বিগ্রহের মধ্যে লীন করে দিতে চেয়ে থাকেন তাহলেও গুণ্ডিচা বাড়ি বা তোটা গোপীনাথের পরিবর্তে জগন্নাথ মন্দিরেরই বেশী প্রাধান্য পাওয়ার কথা। কারণ মহাপ্রভু যে জগন্নাথ অন্তপ্রাণ ছিলেন সেটা একবাক্যে সকলেই স্বীকার করবেন। অতএব আমরা ধরে নিতে পারি যে মহাপ্রভুর রহস্যমণ্ডিত দেহত্যাগের ক্ষেত্র ছিল জগন্নাথ মন্দির। এমনও হতে পারে যে মহাপ্রভু তোটা গোপীনাথের মাঝে আপন শক্তিসঞ্চার করে দিয়ে সুড়ঙ্গপথে সেখান থেকে বেরিয়ে জগন্নাথ মন্দিরেই চলে এসেছিলেন তাঁর স্থূলদেহের শেষ পরিণতিকে নির্ভয়ে বরণ করে নিতে। যাঁর স্পর্শে কত অসুস্থ হয়ে উঠেছে সুস্থ, যাঁর ডাকে শ্রীবাস পণ্ডিতের মৃত সন্তানের আত্মা পরলোক থেকে ফিরে এসে বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিয়ে গেছে তাঁর পক্ষে আপন ভবিতব্য সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া তো খুবই স্বাভাবিক। তাই নিশ্চয়ই সজ্ঞানে সব জেনেশুনেই তোটা গোপীনাথের মধ্যে নিজের সমস্ত শক্তি সঞ্চার করে দিয়ে মহাপ্রভু ফিরে এসেছিলেন জগন্নাথ মন্দিরে নিজের স্থূলদেহের শেষ মুহুর্তটিকে বরণ করে নিতে।"

সুজয় বলে, "তুমি তো ওড়িয়া কবি গোবিন্দের মতটিকে ধরলেই না। তিনি লিখেছিলেন যে মহাপ্রভু ফাল্গুনের শুক্লা একাদশী তিথিতে বৈকুন্ঠে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেইমত সমুদ্রতীরের একটি কুটিরে তিনি সমাধিমগ্ন হন। পাঁচদিন সমাধিতে থাকার পর সন্ধ্যাবেলায় সমাধি থেকে উঠে তিনি সবাইকে ডাক দেন। তারপর শুরু করেন হরিনাম। গোবিন্দ
বলছেন যে সেই নাম করতে করতেই সহসা তিনি বিদ্যুতের মত অন্তর্হিত হয়ে যান।" 

আমি বলি, "গোবিন্দের মতটা না ধরার কারণ এই ব্যাখ্যাটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। যদি সত্যিই তেমনটি হত তাহলে নিশ্চয়ই সমুদ্রতীরে আজ আমরা মহাপ্রভুর সমাধিমন্দির দেখতে পেতাম। মহাপ্রভু তাঁর ভক্ত হরিদাস ঠাকুরকে সমুদ্রতীরে সমাধি দেয়ায় সেখানে মঠ তৈরী হয়ে গেল আর স্বয়ং মহাপ্রভু যেখানে অন্তর্দ্ধান করলেন সেখানে কোন স্মৃতিচিহ্নই রইল না এতো নিতান্তই অবাস্তব ব্যাপার। এজন্যই বৈষ্ণব ভক্তরা এই মতটিকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন।"

মধুপর্ণা বলে, "তাহলে দ্যাখো মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধানের ক্ষেত্র সম্বন্ধে বৈষ্ণবদাস, অচ্যুতানন্দ, দিবাকরদাস, ঈশ্বরদাস ও ঈশান নাগর বলছেন জগন্নাথ মন্দির। লোচনদাস বলছেন গুণ্ডিচা বাড়ি। আবার জয়ানন্দ, নরহরি চক্রবর্তি ও সদানন্দ কবিসূর্য্য ব্রহ্ম বলছেন তোটা গোপীনাথের মন্দির এবং গোবিন্দ বলছেন সমুদ্রতীরের কুটির। অন্যদিকে অন্তর্দ্ধানের সময় প্রসঙ্গেও দেখা যাচ্ছে নানা মত। ঈশ্বরদাস বলছেন বৈশাখের শুক্লা তৃতীয়া, জয়ানন্দ বলছেন আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমীর রাত দশটা, লোচনদাস বলছেন আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমীর বেলা তিন প্রহর, গোবিন্দ বলছেন ফাল্গুনের পূর্ণিমা এবং বৈষ্ণবদাস বলছেন আষাঢ়ের পূর্ণিমা। কিন্তু প্রশ্ন হল - মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্দ্ধান প্রসঙ্গে এত মত আসছে কেন?"

আমি বলি, "কারণটা সহজেই অনুমেয়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দেহরক্ষার পর পুরীধামে একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। তাই দীর্ঘদিন এ ব্যাপারে কেউ মুখ খোলার সাহস পাননি। ফলে সময়ের সাথে সাথে ঘটনাটি নানাজন নানাভাবে পরিবেশন করেছেন জনমানসে। তারই ফলে এমন গোলমাল হয়েছে দিন-তিথির হিসেবে।"

সুজয় জিজ্ঞাসা করে, "তাহলে তোমার কি মত - কোথায় এবং কখন মহাপ্রভুরদেহরক্ষা হয়েছে?" 

আমি বলি, "আমার মগজাস্ত্র প্রয়োগ করলে স্থান হিসেবে তো জগন্নাথ মন্দিরের নামটাই মনে হয়। আর যেহেতু বৈষ্ণবদাসের বিবরণটা যুক্তিযুক্ত তাই আষাঢ়ের পূর্ণিমাকেই বেছে নেব তাঁর তিরোধানের কাল হিসেবে। সেইসাথে তাঁর 'জগন্নাথ অঙ্গে লীন' হওয়া যে কোন রহস্যের দিকে ইঙ্গিত করছে (সে রহস্য জাগতিক হোক বা মহাজাগতিক) তাতো উপরের বিবরণগুলি থেকেই বোঝা যায়।"

-"কি সেই রহস্য?”

-"অস্বাভাবিকভাবে মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধান।"

মধুপর্ণা বলে, "এই অন্তর্দ্ধানের নেপথ্যে কাদের হাত থাকতে পারে?"

আমি বলি, "এ প্রসঙ্গে প্রথমে জাগতিক দিক থেকেই রহস্যটিকে বিশ্লেষণ করা যাক। আর এই জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হলে ইতিহাসেরই শরণ নেয়া বাঞ্ছনীয়। আমাদের দেখতে হবে সেসময়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বিরোধী কারা ছিলেন? এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলি - এতক্ষণ যাঁদের মতের কথা বিশ্লেষণ করলাম তার মধ্যে কারোর মতে শুনেছ কি যে পাণ্ডাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে?"

-"নাঃ। কিন্তু মন্দিরে মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধান হলে সে সম্বন্ধে পাণ্ডাদেরই তো জানার
কথা।"
  .........................

গ্রন্থ - মহাপ্রভুর নীলাচলে আজো চলে লীলা
 লেখক - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
 গ্রন্থ মূল্য - ১২০/-
  পৃষ্ঠা -২৪০।
  প্রকাশনা - জয় মা তারা পাবলিশার্স।

 সম্পূর্ণ বইটি 20 % ছাড়ে কিনে পড়তে যোগাযোগ করতে পারেন -

   আমাদের প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত সাধক লেখক তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের এই বইয়ের অনলাইন প্রাপ্তিস্থান - আমাদের জয় মা তারা পাবলিশার্সএর ফেসবুক পেজ -
  https://www.facebook.com/JayMaTaraPublisher?mibextid=ZbWKwL

   সাথে হোয়াটস আপ করে অর্ডার দিতে পারেন এই নম্বরে। থাকছে বিশেষ ডিসকাউন্ট ।
  9153391909।

কলেজস্ট্রিট থেকে যারা হাতে হাতে বই নিতে চান তাঁরা যেতে পারেন -

  ১) মহেশ লাইব্রেরি (9123923531)
 
  ২) দে বুক স্টোর (দীপুবাবু) - (9143549970)

বইটি boichitro.in থেকে  কেনার লিংক -
  https://boichitro.in/product/mahaprabhur-nilachole-ajo-chole-lila-%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AD%E0%A7%81%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%86/

বইটির ebook ডাউনলোড করার লিংক -

https://play.google.com/store/books/details/Tarashis_Gangopadhyay_%E0%A6%AE%E0%A6%B9_%E0%A6%AA_%E0%A6%B0%E0%A6%AD_%E0%A6%B0_%E0%A6%A8_%E0%A6%B2_%E0%A6%9A%E0%A6%B2_%E0%A6%86%E0%A6%9C_%E0%A6%9A%E0%A6%B2_%E0%A6%B2_%E0%A6%B2?id=M2o9EAAAQBAJ

#booklover 
#books
#booknow
#ভক্ত
#জয়_মা_তারা_পবলিশার্স
#spiritualgrowth
#spirituality
#spiritualjourney
#spiritualbooks
#devotionalbook
#devotion
#devotional
#virals
#viralpost
#publisherstory
#publishing
#combo
#offers
#readers
#readerscommunity
#grow
#soul
#development
#journey
#jaymatarapublishers

No comments:

Post a Comment