Ami Tarashis Bolchi

Ami Tarashis Bolchi
The blog of Tarashis Gangopadhyay (click the photo to reach our website)

Tuesday 19 March 2024

সত্যের আলোয় বাল্মীকির রামায়ণ। - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় দুই - শ্রীরামের ধরাধামে আবির্ভাব প্রসঙ্গ এবং রামায়ণ যে আর্য অনার্যের যুদ্ধ নয় তার প্রমাণসহ বিশদ আলোচনা।

সত্যের আলোয় বাল্মীকির রামায়ণ।
           - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
 
     দুই - (সর্গ ৫ - ১৮)  শ্রীরামের ধরাধামে আবির্ভাব প্রসঙ্গ এবং রামায়ণ যে আর্য অনার্যের যুদ্ধ নয় তার প্রমাণসহ বিশদ আলোচনা।

*                 *                *

    শ্রীরামচন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞের সভায় সানন্দে চেয়ে থাকেন তাঁর প্রতিবিম্বস্বরূপ দুই বালক লব কুশের দিকে। নৃপতির স্নেহদৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে শ্রীরামের দিকে চেয়ে লব কুশও শুরু করেন মধুর কণ্ঠে রামায়ণ গান -

যাঁদের বংশে সগর রাজা জন্মেছিলেন, যাঁর গমনকালে ষাট হাজার পুত্র অনুগমন করতেন, যিনি সাগর খনন করিয়েছিলেন, সেই ইক্ষাকুদের বংশ এই রামায়ণে কীর্তিত হয়েছে। আমরা ধর্ম-কাম-অর্থ যুক্ত এই আখ্যান আদ্যন্ত গান করব। আশা করব আপনারা সবাই অসূয়াশূন্য হয়ে এই গান শুনবেন।

সরযূতীরে কোশল নামে এক আনন্দময় সমৃদ্ধিশালী  ধনধান্য- সম্পন্ন বিরাট জনপদ আছে। তার রাজধানী হল অযোধ্যা। স্বয়ং মানবেন্দ্র মনু এই পুরী নির্মাণ করেছিলেন। এই সুদৃশ্য মহানগরী দ্বাদশ যোজন দীর্ঘ, তিন যোজন বিস্তৃত এবং প্রশস্ত মহাপথ  ও রাজমার্গে  সুবিভক্ত। এই সকল পথ বিকশিত পুষ্পে অলংকৃত এবং নিত্য জলসিক্ত। রাজা দশরথ অমরাবতীতে ইন্দ্রের মতই এই অযোধ্যায় বাস করতেন। এই শ্রীসম্পন্ন অতুলপ্রভাসমন্বিত পুরী উঁচু উঁচু অট্টালিকা ও ধ্বজাসমূহে শোভিত। এখানে বহু স্থানে পুরনারীদের জন্য নাট্যশালা, উদ্যান ও আমবন আছে। নগরীর চতুর্দিক শালবনে বেষ্টিত। দুর্গম গভীর পরিখা থাকায় সেখানে অন্যের প্রবেশ দুঃসাধ্য। 

     সেই অযোধ্যায় বেদজ্ঞ দূরদর্শী মহাতেজস্বী রাজা দশরথ রাজত্ব করতেন। সেখানকার লোকেরা সুখী, ধর্মপরায়ণ, শাস্ত্রজ্ঞ, নির্লোভ ও সত্যবাদী ছিল। অযোধ্যায় কামাসক্ত, নীচ প্রকৃতির নৃশংস পুরুষ, অবিদ্বান,  নাস্তিক, মিথ্যাবাদী, অল্পশাস্ত্রজ্ঞ, অসূয়াপরবশ বা অসমর্থ কেউ ছিল না।
   দশরথ দক্ষতার সঙ্গে রাজ্য শাসন করতেন । তাই তাঁর রাজ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় থাকত। রাজগুরু ঋষি বশিষ্ঠ এবং ঋষি বামদেবের সৎ পরামর্শ রাজাকে সৎপথে রাজ্যশাসন করতে সাহায্য করত। দশরথের মন্ত্রীরা ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এবং  নীতি, অর্থনীতি ও প্রশাসনের বিশেষজ্ঞ। তাঁরা জানতেন কিভাবে কোষাগার  সমৃদ্ধ করতে হয়, সেনাবাহিনীকে ভালভাবে পরিচালনা করতে হয় এবং গোপনীয়তা বজায় রাখতে হয়। অযোধ্যার বিচার ব্যবস্থা বড় ভাল ছিল। সেখানে কখনো দোষীদের ছাড়া হত না এবং নিরপরাধ কখনো শাস্তি পেত না। এমনই ছিল অযোধ্যার খ্যাতি ও জাঁকজমক। এহেন অমরাবতীতুল্য অযোধ্যার রাজা দশরথ সম্পর্কে বলা হত যে তিনি ছিলেন একজন 'রাজর্ষি'। 
   এই রামগানকে কেন্দ্র করেই বাল্মীকি তুলে ধরেন শ্রীরামের বংশপরিচয়।
    যদিও রামায়ণের মূল কাহিনী মূলতঃ শ্রীরামের জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে, ঋষি বাল্মীকি মহাকাব্যে তাঁর  পূর্বপুরুষদের বিশদভাবে উল্লেখ করেছেন। রামায়ণে শ্রীরামের বংশের কথা এই রামগান ছাড়াও ঋষি বশিষ্ঠ দুবার বর্ণনা করেছেন  - প্রথমে শ্রীরাম ও সীতার বিয়েতে এবং তারপর আবার চিত্রকূটে, যখন ভরত শ্রীরামকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে রাজি করাতে চেষ্টা করছিলেন।
    অযোধ্যার এই  রাজবংশের সবচেয়ে বিখ্যাত পূর্বপুরুষ ছিলেন মনুর পুত্র এবং বিবস্বান তথা সূর্যের নাতি রাজা ইক্ষ্বাকু ; সূর্যের নাতি হওয়ায় ইক্ষ্বাকুর বংশকে সূর্যবংশ বা সৌর রাজবংশ বলা হত।  আবার ইক্ষ্বাকুর নাম অনুসারে তাঁর বংশের নাম সুবিখ্যাত ছিল ইক্ষ্বাকু বংশরূপে।  
     ইক্ষ্বাকু রাজবংশের আরেক মহান রাজা রঘুর নাম অনুসারে তাঁর রাজবংশকে রঘুবংশও বলা হয়।  ইক্ষ্বাকুর অন্যান্য বিখ্যাত বংশধর এবং শ্রীরামের পূর্বপুরুষরা হলেন  ত্রিশঙ্কু, সগর, দিলীপ, ভগীরথ, কাকুস্থ, প্রবৃদ্ধ এবং দশরথ। এই রাজবংশের রাজা ভগীরথের মাধ্যমেই পৃথিবীতে গঙ্গা নদীর অবতরণ হয়েছে। অর্থাৎ দশরথের বংশ যে সেইসময়কার সবচেয়ে সমৃদ্ধ বংশ ছিল তা বোঝাই যাচ্ছে।
    কিন্তু নামখ্যাতি যশ অর্থ সুখ সব থাকলেও রাজা দশরথের ছিল না কোন পুত্রসন্তান। তাই তাঁর মন এক অব্যক্ত অশান্তিতে পূর্ণ থাকত। তবে সব সমস্যার সমাধান তো থাকেই। এক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হল না। মন্ত্রীদের পরামর্শে তিনি অশ্বমেধ তথা পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করবেন বলে মনস্থ করেন। এই যজ্ঞে পৌরহিত্য করার জন্য তিনি তাঁর সুহৃদ রাজা লোমপাদের সঙ্গে দেখা করে তাঁর জামাই ঋষি ঋষ্যশৃঙ্গকে সস্ত্রীক আমন্ত্রণ জানালেন অযোধ্যায়। ঋষিও সানন্দে সম্মত হলেন।
   যথাসময়ে ঋষ্যশৃ‌ঙ্গকে সঙ্গে নিয়ে দশরথ অযোধ্যায় প্রবেশ করলেন। ঋষ্যশৃঙ্গের আগমনে অযোধ্যাবাসীরা অত্যন্ত আনন্দিত হ'ল। 
যথাসময় বসন্তকাল উপস্থিত হ'ল দেশে। তখন রাজা দশরথ ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রণাম ক'রে যজ্ঞের প্রধান যাজকরূপে বরণ করলেন এবং বশিষ্ঠ বামদেব প্রভৃতি ঋত্বিক ব্রাহ্মণদেরও যজ্ঞের সংকল্প জানালেন। তাঁরা সকলে দশরথকে সাধুবাদ দিলেন এবং সরযূর উত্তর তীরে যজ্ঞভূমি নির্মাণ করে যজ্ঞের অশ্বকে বন্ধনমুক্ত করতে বললেন। দশরথ বিরাট সৈন্যবাহিনী সেই অশ্বের সঙ্গে পাঠালেন। আর অমাত্যদের যথাবিধি সমস্ত আয়োজন করবার ভার দিলেন। এক বছর ধরে চলল এই আয়োজন।
   যথাসময় বছর ঘুরে পরবর্তী বসন্তকাল এসে গেল। তখন দশরথ মহর্ষি বশিষ্ঠকে বললেন, "গুরুদেব, আপনি যথাবিধি আমার যজ্ঞ সম্পাদন করুন। যাতে যজ্ঞের কোনও অঙ্গে বিঘ্ন না হয় তার বিধান করুন।"
   রাজাকে আশ্বস্ত করে বশিষ্ঠ স্থপতি, শিল্পকার, সূত্রধর, খনক, গণক, নট, নর্তক এবং শুদ্ধস্বভাব শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণকে ডেকে আনিয়ে রাজার আজ্ঞানুসারে  
সব ব্যবস্থা করলেন এবং পৃথিবীতে যত ধার্মিক রাজা আছেন তাঁদের নিমন্ত্রণ পাঠালেন। যথাসময়ে শুভনক্ষত্রযুক্ত দিনে রাজা দশরথ যজ্ঞভূমিতে গেলেন এবং পত্নীগণসহ যজ্ঞে দীক্ষিত হলেন।
   ইতিমধ্যে যে যজ্ঞাশ্ব এক বছর আগে ছাড়া হয়েছিল তা সমগ্র আর্যাবর্ত ঘুরে ফিরে এল। এবার বশিষ্ঠসহ দ্বিজগণ ঋষ্যশৃঙ্গকে সামনে রেখে শাস্ত্রানুসারে যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। দেবতাদের উদ্দেশে যে সকল পশুপক্ষী অশ্ব ও জলচর সংগৃহীত ছিল সে সমস্তই ঋষিগণ যথাবিধি বধ করলেন। যুপকাঠে তিনশো পশু এবং রাজা দশরথের অশ্বমেধের উৎকৃষ্ট অশ্ব বাঁধা ছিল। কৌশল্যা সেই অশ্বের সম্যক পরিচর্যা ক'রে  তিন খড়গাঘাতে তাকে বধ করলেন। তার পর তিনি ধর্মকামনায় সুস্থিরচিত্তে সেই নিহত অশ্বের সঙ্গে এক রাত যাপন করলেন। কৈকেয়ী এবং সুমিত্রা সঙ্গে রইলেন।
শ্রৌতকর্মে নিপুণ ঋত্বিক সেই অশ্বের শব নিয়ে যথাশাস্ত্র হোম করলেন। ষোল জন ঋত্বিক অশ্বের সমস্ত অঙ্গ অগ্নিতে আহুতি দিলেন। যজ্ঞ শেষ হল যথাসময়ে। তারপর দশরথ যাজক ও অন্যান্য ব্রাহ্মণদের প্রচুর দক্ষিণা দিলেন। সকলেই হৃষ্ট মনে রাজাকে আশীর্বাদ করতে লাগলেন। এরপর ঋষ্যশৃঙ্গ অথর্বোক্ত মন্ত্রে যথাবিধি পুত্রেষ্টি যজ্ঞ আরম্ভ করলেন।
   যে সময়ে রাজা দশরথ এই যজ্ঞ করছিলেন তখন দেবলোকে চলছিল ত্রিভুবন রক্ষার প্রচেষ্টা। এই সময়ে লঙ্কার রাজা রাবণের অত্যাচারে ত্রিভুবন ছিল কম্পিত। তাই দেবতারা তখন ব্রহ্মার কাছে গিয়ে বললেন, "ভগবান, রাক্ষসরাজ রাবণ আপনার বরে বলীয়ান হয়ে আমাদের পীড়ন করছে, তার বিনাশের উপায় স্থির করুন।"
    উত্তরে ব্রহ্মা বললেন, "রাবণ আমার কাছে বর চেয়েছিল যে গন্ধর্ব যক্ষ দেব দৈত্য নাগ গরুড় ও রাক্ষসের হাতে যেন তার মৃত্যু না হয়। আমিও তাকে সেই বর দিয়েছি। সে অবজ্ঞাবশে মানুষের নাম করে নি। তাই  সেই মানুষরূপে ভগবান বিষ্ণুই তাকে বধ করবেন।"
   অতঃপর দেবতারা বিষ্ণুর স্মরণ নেন। তখন শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী গরুড়বাহন বিষ্ণু সেখানে আবির্ভূত হন। দেবগণ স্তব করে তাঁকে বলেন, " প্রভু, ত্রিভুবনের হিতকামনায় আমাদের একটি প্রার্থনা আপনার কাছে আছে। বর্তমানে অযোধ্যাপতি দশরথ পূত্রেষ্টি যজ্ঞ করছেন। তাঁর  তিন মহিষী আছেন। আপনি কৃপা করে চার অংশে বিভক্ত হয়ে সেই তিন মহিষীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করুন এবং মানুষ রূপে অবতীর্ণ হয়ে দেবতাদের অবধ্য দুরাচারী রাবণকে বধ করুন। সেই রাক্ষস আমাদের সকলের উপর অকথ্য অত্যাচার করছে। তাই তার নিধনের জন্য আমরা আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।"
  বিষ্ণু তখন তাঁদের অভয় দিয়ে বললেন, "তোমরা ভীত হয়ো না। আমি রাবণকে অবশ্যই সবংশে সংহার করব।"
  অন্যদিকে তখন ঋষ্যশৃঙ্গের উপদেশ অনুসারে দশরথ যজ্ঞ করছিলেন। যথাসময় যজ্ঞাগ্নি থেকে আবির্ভূত হলেন কৃষ্ণকায়, রক্তাম্বরধারী,  শুভলক্ষণসম্পন্ন, দিব্য আভরণে ভূষিত এক বিরাট মূর্তি। তাঁর হাতে ছিল তপ্তকাঞ্চনগঠিত রজতাবরণযুক্ত দিব্য পায়সে পরিপূর্ণ এক বিরাট পাত্র।
যজ্ঞাগ্নি থেকে উত্থিত ব্যক্তি রাজা দশরথকে বললেন, "আমি প্রজাপতিপ্রেরিত পুরুষ। মহারাজ, এই দেবনির্মিত সন্তানদায়ক পায়স আপনার পত্নীদের খেতে দিন।"
  দশরথ সেই পাত্র মাথায় ঠেকিয়ে গ্রহণ করলেন এবং অন্তঃপুরে এসে পায়সের অর্ধাংশ কৌশল্যাকে দিলেন। অবশিষ্ট অর্ধেকের অর্ধাংশ সুমিত্রাকে দিলেন। অবশিষ্টের অর্ধ কৈকেয়ীকে দিয়ে মনে মনে বিবেচনার পর শেষ অংশ আবার সুমিত্রাকেই দিলেন। অর্থাৎ ১৬ ভাগের ৮ ভাগ কৌশল্যা, ৬ ভাগ সুমিত্রা, এবং ২ ভাগ কৈকেয়ী পেলেন। তিন রানী সেই পায়স খেয়ে অচিরে গর্ভধারণ করলেন।
  অশ্বমেধ যজ্ঞ শেষ হবার পর নিমন্ত্রিত রাজারা, অন্যান্য অতিথিরা এবং সপত্নীক ঋষ্যশৃঙ্গ নিজ নিজ দেশে ফিরে গেলেন। এর বারো মাস পূর্ণ হবার পর মহারানী কৌশল্যা চৈত্রের নবমী তিথিতে পুনর্বসু নক্ষত্রে শ্রীরামকে প্রসব করলেন। তারপর রানী কৈকেয়ী পুষ্যা নক্ষত্রে ভরতকে এবং রানী সুমিত্রা অশ্লেষা নক্ষত্রে লক্ষণ-শত্রুঘ্নকে প্রসব করলেন।  অযোধ্যায় নানাপ্রকার উৎসব আরম্ভ হ'ল। জন্মের এগার দিন পরে বশিষ্ঠ রাজকুমারদের নামকরণ করলেন।
   সময়ের সাথে সাথে রাজকুমারদের সকলেই বড় হয়ে উঠলেন। তাঁরা সকলেই  হয় উঠলেন মহাবীর, লোকহিতে রত, জ্ঞানবান ও গুণবান। তেজস্বী পরাক্রমশালী শ্রীরাম নির্মল শশাঙ্কের মত সকলের প্রাণপ্রিয় ছিলেন। তিনি হাতি ঘোড়া ও রথ চালনায় যেমন পটু ছিলেন তেমনিই ছিলেন ধনুর্বিদ্যায়  পারদর্শী। আর পিতার সেবা শুশ্রুষায়  ছিল তাঁর অসীম অনুরাগ।
    লক্ষ্মণ  ছোটবেলা থেকেই সবসময় শ্রীরামের ছায়ার মত থাকতেন এবং তিনি শ্রীরামের দ্বিতীয় প্রাণতুল্য ছিলেন। ভরত শত্রুঘ্নর মধ্যেও সেইরকম স্নেহের ও প্রীতির সম্বন্ধ গড়ে উঠল।
     অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে রাবণ বধের জন্যেই শ্রীরামচন্দ্রের আবির্ভাব হয়েছিল ধরাধামে। আর বিভিন্ন রামায়ণের সংস্করণে রাম রাবনের যুদ্ধকে আর্য অনার্যের সংগ্রাম বলে মনে করা হয়। একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব আছে যে আর্য শব্দটি ফর্সা-বর্ণের লোকদের একটি জাতিকে বোঝায় যারা ইউরোপের তৃণভূমি থেকে ভারতীয় উপদ্বীপে এসেছিল।  তারা বৈদিক সংস্কৃতি নিয়ে এসেছেন এই দেশে এবং তাঁদের মাধ্যমেই সরস্বতী-সিন্ধু সভ্যতার আদি বাসিন্দা দ্রাবিড়দের বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। এটি আর্য অভিবাসন তত্ত্ব নামে পরিচিত।  তাই অনেক গবেষকের মতে রাম এবং রাবণের যুদ্ধ ধর্মের চেয়ে আর্য এবং দ্রাবিড়দের মধ্যে জাতিগত দ্বন্দ্বের সাথে অধিক সম্পর্কযুক্ত।
  তবে, রামায়ণে আর্য-দ্রাবিড় দ্বন্দ্ব আরোপিত হলেও এই মহাকাব্যে আর্য এবং অনার্য শব্দগুলি কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তা লক্ষ্য করার মতো।
এই দুটি শব্দই রামায়ণে একাধিকবার এসেছে। আর্য শব্দটি ধারাবাহিকভাবে ভদ্র মানুষজনের  গুণ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে - এ হল এমন একটি আচরণ যা সভ্য মানুষদের কাছে প্রত্যাশিত।
    অনেকেই বলেন যে এই আর্যরা কেবল নিজেদের সভ্য বলে মনে করত এবং তাই এই গুণটিকে তাদের নিজস্ব জাতির সমার্থক বলে মনে করত।  যদি আমরা যুক্তির এই লাইনটি মেনে নিই, তাহলে বোঝা যাবে যে ত্রেতা যুগে ভারতীয় উপদ্বীপের উত্তর থেকে দক্ষিণে সুর্যবংশ, রাবণের রাক্ষস বংশ এবং সেই সাথে বানর উপজাতির সবাই ছিল আর্য। সবাই ইতিবাচকভাবে একই জাতির অন্তর্গত। এর স্বপক্ষে একাধিক প্রমাণ মেলে।        প্রথমত, রাজা দশরথ রামের নির্বাসন চাওয়ার জন্য নিজের রানী কৈকেয়ীকে অনার্য বলেন।  
    দ্বিতীয়ত জনস্থানে মারীচের কণ্ঠে  " হায় লক্ষ্মণ" শুনেও শ্রীরামের সাহায্য করার জন্য ছুটে না আসার জন্য সীতা স্বয়ং তাঁর দেওর লক্ষ্মণকে অনার্য বলেন।
     তৃতীয়ত, রাবণ এবং ইন্দ্রজিৎ রামের পক্ষে চলে যাওয়ার জন্য বিভীষণকে অনার্য বলেন।
    চতুর্থত, রাবণ যুদ্ধে শ্রীরামের শরাঘাতে অচেতন হয়ে পড়লে তার সারথি যখন তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিয়ে পালিয়ে যান তখন রাবন কাপুরুষতা দেখানোর জন্যে সারথীকে অনার্য বলেন।
  পঞ্চমত, সীতা দেবী হনুমানকে রাক্ষসীদের হত্যা না করার জন্য অনুরোধ করেন কারণ তারা কেবল রাবণের আদেশ পালন করছিল।  এদের মত আজ্ঞাবাহীদের হত্যা কোন আর্যদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। 
   এছাড়া রামায়ণ পড়লে আমরা দেখব যে মন্দোদরী এবং রাবণের অন্যান্য স্ত্রীরা তথা রাক্ষসবাহিনীর সেনাপতিরাও রাবণকে আর্য এবং আর্যপুত্র  বলে উল্লেখ করেছেন। বানরদের রানী তারা তাঁর স্বামী বালীকে  আর্য সম্বোধন করেছেন। অর্থাৎ রামায়ণ অনুসারে আর্য কোন ভদ্রলোকের বিশেষণ বোঝাতে   ব্যবহৃত হয়েছে এবং অনার্য কোন অসভ্য, প্রতারক, ভীরু ব্যক্তিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।
  এছাড়া অযোধ্যায় যেমন বৈদিক মত অনুসারে যজ্ঞ করতে দশরথ ও শ্রীরামকে দেখা গেছে তেমনি লঙ্কায় রাবণ, ইন্দ্রজিতকেও দেখা গেছে বৈদিক মন্ত্র অনুসারে যজ্ঞ করতে। তাই রামায়ণের যুগে এই রাম রাবনের যুদ্ধ কোন আর্য অনার্যের যুদ্ধ নয়। এটি ছিল শুভ শক্তি ও অশুভ শক্তির মধ্যে যুদ্ধ। আর এরা সকলেই নিজেদের আর্য মানতেন।
   যাহোক আবার কাহিনীতে ফেরা যাক।  যথাসময়ে রাজা দশরথের চার পুত্র বড় হয়ে উঠলেন সানন্দে। তবে শ্রীরামচন্দ্র ষোলো বছরে পদার্পণ করার আগেই তাঁর জীবনে এল এক নতুন অভিযানের সুযোগ। 
                       (ক্রমশ)


  #বাল্মিকী #রামায়ণ #valmiki #ramayana #rama #sita #ravan #আধ্যাত্মিক #devotion #epic #মহাকাব্য

10 comments:

  1. অনেক অজানা আজ তোমার লেখার মাধ্যমে জানতে পেরে খুব ভালো লাগছে ❤️🙏🌹

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো দাদাভাই 🙏 অনেক অজানা তথ্য তোমার কাছ থেকে জানতে পারছি। এখন দিকে দিকে যেভাবে রামায়ণের অপপ্রচার চলছে, সেখানে তোমার এই মূল লেখাকে তুলে ধরা সকলকে আলো দেখাবে।

    ReplyDelete
  3. আমাদের সাংস্কৃতিক ধমনীতে বয়ে চলা এই কাহিনীর শিহরণ, নতুন করে ভালো লাগলো তোমার লেখা পড়ে। কাকু ছোটবেলা থেকেই শ্রীরামভক্ত ছিলেন, ওনার মুখেই শোনা। বিষয়টি নিয়ে একটা webinar করতে পারো। আরো পড়ার ইচ্ছা রইল।

    ReplyDelete
  4. Khub valo laglo Dada 🙏Tomar lekha pore sob somoy notun kichu jante pari.. onek ojana tatho jante parchi.

    ReplyDelete
  5. খুব ভালো লাগছে। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি।

    ReplyDelete
  6. Khub bhalo lagche dada, Ramayan ke jeno anno bhabe podchi

    ReplyDelete
  7. 🙏🙏🙏🙏

    ReplyDelete
  8. Khub valo lagchhe. Ramayan niye ei udyog khub e important. Porer part er opekhyay achhi.

    ReplyDelete