Ami Tarashis Bolchi

Ami Tarashis Bolchi
The blog of Tarashis Gangopadhyay (click the photo to reach our website)

Friday 22 March 2024

সত্যের আলোয় বাল্মীকির রামায়ণ। তিন (সর্গ ১৯ - ৩০) - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় বিশ্বামিত্রের সঙ্গে শ্রীরামের বনগমন এবং তারকা বধ, মারীচ সুবাহু দমন ও বিশ্বামিত্রের যজ্ঞ রক্ষা।

সত্যের আলোয় বাল্মীকির রামায়ণ।
           - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
 
     তিন -  বিশ্বামিত্রের সঙ্গে শ্রীরামের বনগমন এবং তারকা বধ, মারীচ সুবাহু দমন ও বিশ্বামিত্রের যজ্ঞ রক্ষা।

*                  *                  *

   শ্রীরামের বয়স তখন প্রায় ষোল। একদিন দশরথ রাজসভায় বসে তাঁর ছেলেদের বিয়ের কথা ভাবছিলেন এমনসময়ে একজন রাজপ্রহরী ছুটে এসে খবর দেয়, "মহারাজা, ঋষি বিশ্বামিত্র আপনার সাক্ষাতপ্রার্থী।" 
    এই খবর শুনে রাজা দশরথ অত্যন্ত প্রীত হলেন। বিশ্বামিত্রের যোগক্ষেমের খ্যাতি তাঁর অবিদিত ছিল না। তাই তিনি স্বয়ং এগিয়ে গিয়ে ঋষিকে অভ্যর্থনা করে তাঁর  রাজদরবারে নিয়ে গেলেন।  প্রথাগত সৌজন্যের পর, দশরথ সানন্দে ঋষিবর বিশ্বামিত্রকে বললেন, "এখানে আপনার আগমন দুর্ভিক্ষের সময় বৃষ্টিপাতের মতই আনন্দদায়ক। আমাকে অনুগ্রহ করে বলুন - আমি আপনার জন্য কি করতে পারি? আপনার আকাঙ্খাই আমার কাছে আদেশ। সেই আদেশ  জানতে পারলে আমি নিশ্চয় তা রাখব।'

   দশরথের উষ্ণ অভ্যর্থনায় বিশ্বামিত্র খুশি হলেন। তারপর সানন্দে বললেন, "আমার আকাঙ্ক্ষা কী তা আমি আপনাকে বলব বলেই তো এসেছি। বর্তমানে আমি একটি বিশেষ যজ্ঞ সম্পন্ন করার সংকল্প গ্রহণ করেছি।  কিন্তু দুজন শক্তিশালী রাক্ষসের জন্যে আমি এই যজ্ঞ পূর্ণ করতে পারছি না।  তারা আমার যজ্ঞবেদীতে কাঁচা মাংসের টুকরো নিক্ষেপ করে আমার যজ্ঞের আচার অনুষ্ঠানে বারবার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। তাদের প্রতিরোধ করার  সমস্ত প্রচেষ্টা বৃথা হয়ে গেছে।  সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও আমি নিজে তাদের শাস্তি দিতে পারছি না যেহেতু এই যজ্ঞ আমার সংকল্প এবং যজ্ঞে বসার পর ওঠা অনুচিত। তাই আমার যজ্ঞবেদী পাহারা দিতে  আপনার পুত্র শ্রীরামকে  আমায় দশ দিনের জন্য দিন।   আমি নিশ্চিত যে শ্রীরামের সুরক্ষায় আমি এই যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারব।  এর জন্য আমি তাকে এমন দক্ষতা এবং শক্তি প্রদান করব যা তাকে এই পৃথিবীতে বিশিষ্ট যশখ্যাতি এনে দেবে।  আমি স্বয়ং আপনাকে শ্রীরামের নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছি। আমি জানি শ্রীরাম আপনার অতি প্রিয়। কিন্তু তাই বলে আপনার পিতার ভালবাসা যেন আপনার ইতিপূর্বে দেয়া কথার সম্মান নষ্ট না করে।  আপনার মন্ত্রীগন এবং ঋষি বশিষ্ঠের মত সম্মানিত ঋষির সাথে পরামর্শ করে আপনার সিদ্ধান্ত আমাকে জানান।"

  ঋষির মুখে এহেন কথা শুনে রাজা দশরথ হতভম্ব হয়ে গেলেন। শ্রীরামই যে তাঁর কাছে সবকিছু। তাঁকে তিনি এভাবে ঋষির সাথে রাক্ষসদের সাথে যেতে দেন কিভাবে! তাই নিজেকে একটু সামলে নিয়ে তিনি বললেন,  "কিন্তু আমার পুত্র রাম তো এখনো বালক। তার বয়স এখনো ষোল হয় নি। যুদ্ধ বিদ্যা এখনো সে ঠিকমত আয়ত্ত করে নি। আর  রাক্ষসরা সকলেই কূটযোদ্ধা। রাম কোনমতেই তাদের সমকক্ষ নয়। তাই রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার যোগ্যতা তার নেই। তাছাড়া রামের বিচ্ছেদে আমি এক মুহূর্তও বাঁচতে পারব না। তাই যদি নিতান্তই তাকে নিয়ে যেতে চান তবে আমার চতুরঙ্গ সেনার সাথে আমাকেও নিন। আমার সেনাবাহিনী যথেষ্ট দক্ষ। তাদের সাথে আমি স্বয়ং ধনুর্ধারণ করে প্রাণপণে রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করব।" তারপর একটু থেমে তিনি বললেন, "তবে এই রাক্ষসরা কারা যারা আপনার যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে?'

 বিশ্বামিত্র বললেন, "এরা হল মারীচ এবং সুবাহু। এরা লঙ্কার রাজা রাবণের অনুগামী। রাবণের আদেশ অনুসারে এরা কাজ করে। যদিও রাবণের জন্ম ঋষি পুলস্ত্যের বংশে এবং মহান ঋষি বিশ্রবা তার পিতা, কিন্তু ব্রহ্মার বর তাকে বর্তমানে করেছে নির্মম অত্যাচারী এবং অহংকারী। যেখানে সে নিজে যায় না সেখানে সে তার অনুগামী এইসব রাক্ষসদের পাঠায় সাধুদের উপর অত্যাচার করতে।" 
    রাবণের নাম শুনে দশরথ ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি উত্তর দিলেন, " রাবণ তো বিরাট শক্তিশালী রাক্ষস। দেব দানব গন্ধর্ব যক্ষ বা নাগ কেউ যুদ্ধে রাবণের সাথে  এঁটে উঠতে পারে না। মানুষ তো দূর অস্ত। অতএব, আমি সসৈন্যে বা আমার পুত্রকে নিয়ে রাবণের সঙ্গে বা তার অনুচরদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারব না। আপনি আমার ও আমার ছেলে রামের প্রতি দয়া করুন।" অর্থাৎ দেখাই যাচ্ছে যে দশরথ প্রথমে আবেগের বশে কথা দিয়ে ফেললেও পরে অসুবিধা দেখলে কথা ফেলতেও দ্বিধা করেন না। রঘুবংশীয়দের সনাতন রীতি "প্রাণ যায় পর বচন না যায়" তিনি বড় একটা মানতে চান না।
    স্বাভাবিকভাবেই দশরথের এরকম উত্তরে বিশ্বামিত্র মোটেও খুশি হলেন না।  তিনি বরং ব্যঙ্গাত্মকভাবে বললেন, 'আপনি তাহলে কেন কথা দিয়েছেন যে আপনি আমার ইচ্ছা পূর্ণ করবেন। শুনেছি রঘুবংশীয়রা প্রাণ দিয়েও কথা রাখে। কথা দিয়েও কথা না রাখা রঘুর বংশের বংশের কাছে খুবই অপ্রীতিকর।  তবে আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে আপনি যা করছেন তা সঠিক, তাহলে তাই হোক।  আমি যেভাবে এসেছি সেভাবেই চলে যাব।
আপনি শপথ করেও তা না রেখে আপনার অনুগামীদের নিয়ে সুখী থাকুন।"
    ঋষি বিশ্বামিত্রের ক্রোধ দেখে এবার রাজগুরু ঋষি বশিষ্ঠ হস্তক্ষেপ করলেন। কারণ তিনি গুরু। শিষ্যের মঙ্গল দেখা তাঁর কর্তব্য। তিনি চোখের সামনে দেখছেন যে শিষ্য কথা দিয়েও কথার খেলাপ করতে চলেছেন। পুত্রমোহে অন্ধ হয়ে তিনি পুত্রের কিসে সত্যিই ভালো হবে তা দেখতে পারছেন না। অতএব পরম স্নেহাস্পদ দশরথ ও শ্রীরামের কল্যাণের দিকে চেয়ে তিনি দশরথকে বোঝালেন,
 "দশরথ, তুমি তোমার বিচক্ষণতা, সত্যবাদিতা এবং নিজের দেয়া কথার সম্মান রাখার জন্য সুপরিচিত।
তাই কথা দিয়েও মোহের বশে কথা না রেখে অঙ্গীকার ভেঙে নিজেকে অপমানিত কোর না। ঋষি বিশ্বামিত্রকে আমি যেভাবে জানি তা কেউ জানে না।  তাঁর তপস্যা অপরিসীম।  তাঁর পরাক্রম অভূতপূর্ব।  এমন কোন অস্ত্র নেই যার জ্ঞান এই ঋষির নেই।  তাঁর তত্ত্বাবধানে রামের কোনো ক্ষতি হতে পারে না।  তিনি নিজেই রাক্ষসদের শাস্তি দিতে সক্ষম।  তবুও, তিনি রামকে বেছেছেন, নিজের জন্য নয়, রামকেই আগামীদিনের জন্যে যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে। তাই রামকে তুমি যেতে দাও। এতে তার মঙ্গলই হবে।"
   গুরু বশিষ্ঠের কথায় রাজা দশরথ অবশেষে শ্রীরামকে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে পাঠাতে সম্মত হলেন। আর শ্রীরামের সাথে সবসময়ে ছায়ার মত থাকেন লক্ষ্মণ। তাই তিনিও এলেন সঙ্গে। উভয়কেই রাজা দশরথ স্বস্তয়নের পর ঋষি বিশ্বামিত্রের হাতে সমর্পণ করলেন। বিশ্বামিত্র দুই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হলেন তাঁর
সিদ্ধাশ্রমের লক্ষ্যে। 
       সিদ্ধাশ্রম ছিল অযোধ্যা থেকে চারদিনের পথ। সেই পথে পদব্রজে বিশ্বামিত্র এগিয়ে চললেন এবং শ্রীরাম লক্ষ্মণ তাঁকে অনুসরণ করতে লাগলেন। দুই রাজকুমারের কাঁধে ছিল ধনুক এবং তাঁদের পিঠে ছিল তীরভর্তি তুণ। কোমরে ঝোলানো ছিল তেজস্বী তলোয়ার। যদিও দুজনেই রাজার কুমার। এবং বড় হয়েছেন মহলের আরাম ও বিলাসের মাঝে, কিন্তু তাও ঋষির সাথে তপস্বী বালকের মত পদব্রজে গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে পথ চলতে তাঁদের কোন অসুবিধা হয় নি। কারণ গুরু বশিষ্ঠ যে তাঁদের সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন। তাই প্রয়োজনে সবরকম কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে তাঁরা অভ্যস্ত ছিলেন।
    এইভাবে  অযোধ্যা অতিক্রম করে প্রায় দেড় যোজন চলার পর সরযূ নদীর দক্ষিণ তীরে এসে ঋষি বিশ্বামিত্র থামলেন। তিনি এখানে শ্রীরামকে ও লক্ষ্মণকে বল এবং অতিবল বিদ্যা দান করেন। এই বিদ্যাদান ছিল শক্তিশালী মন্ত্র অনুষ্ঠান যা একমাত্র কোন দক্ষ গুরু দিতে পারেন শিষ্যকে। এই মন্ত্র সঙ্গে থাকলে তাঁরা নির্ধারিত কাজে নিযুক্ত থাকার সময় কোনও শারীরিক ব্যথা বা মানসিক ক্লান্তি অনুভব করবেন না এবং তাঁরা ঘুমিয়ে থাকার সময়েও শত্রুদের দ্বারা কখনই পরাভূত হবেন না। এমনকি  ক্ষুধা বা তৃষ্ণাও কখনোই তাঁদের কষ্ট দিতে পারবে না।"
    এককথায়, দুই রাজপুত্রকে ঋষি বিশ্বামিত্রের এই বিদ্যাদানের উদ্দেশ্য ছিল - তাঁদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা এবং ক্লান্তি থেকে সুরক্ষা জোগানো এবং সেইসাথে তাদের মধ্যে অপরিমেয় শক্তি এবং জ্ঞানের সঞ্চার করা।
      তাঁরা তিনজন সেই রাত কাটিয়েছিলেন সরযূর তীরে। ঋষির সাথে অযোধ্যার এই দুই রাজপুত্র বিস্তীর্ণ আকাশের নীচে তৃণশয্যাতেই  ঘুমাতেন যা কোন রাজকুমারের ক্ষেত্রে বেশ ক্লেশদায়ক কিন্তু বিশ্বামিত্রের মধুর ব্যবহার তাঁদের মধ্যে কোন ক্লেশ জাগতে দেয় নি।  বিশ্বামিত্র প্রতি রাতে যেমন  সস্নেহে অনেক কিছু উপদেশ তাঁদের দিয়েছেন তেমনিই তাঁরাও সম্মান ও আনুগত্যের সাথে তাঁর কাছ থেকে আহরণ করেছেন অনেক বিরল জ্ঞান।
   পরদিন ভোরবেলা ঋষি আবার শুরু হল তাঁদের যাত্রা। দ্বিতীয় সন্ধ্যায় তাঁরা সরযূ ও গঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলে অঙ্গদেশের একটি আশ্রমে এসে পৌঁছলেন।  সেখানে এসে বিশ্বামিত্র তাঁদের জানালেন যে পূর্বে এখানে কন্দর্পের আশ্রম ছিল। একবার মহাদেব যখন এখান দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন কন্দর্প তাঁর চিত্তবিকার উৎপাদন করেন। ফলে ক্রুদ্ধ হন মহাদেব। রুদ্রের ক্রোধদৃষ্টিতে কন্দর্পের সর্বাঙ্গ ভস্মীভূত হয়ে যায়। সেই থেকে তাঁর নাম হয় অনঙ্গ এবং এই স্থানের নাম অঙ্গদেশ। তাঁরই শিষ্যরা পুরুষানুক্রমে এই স্থানে বাস করেন। আশ্রমবাসী মুনিরা বিশ্বামিত্রের এখানে আগমনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাঁদের তিনজনের যথোচিত সৎকার এবং রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করে দেন। 
   পরদিন তিন জনে গঙ্গাতীরে এসে নৌকায় উঠলেন গঙ্গা পার হবার জন্য। নদীর মধ্যে এসে শ্রীরাম সহসা শুনতে পেলেন - জলের ভিতর থেকে একটা প্রবল আলোড়ন উঠছে। তিনি কৌতূহলবশে জিজ্ঞাসা করলেন, "আমরা যে জল ভেদ করে যাচ্ছি তার ভিতর থেকে এই তুমুল শব্দ জাগছে কেন?"
    বিশ্বামিত্র বললেন,
"আসলে এই স্থান যে দুই নদীর সঙ্গম। এখান থেকে অযোধ্যার দিকে যে পুণ্যতোয়া নদী গেছে দেখছ তা ব্রহ্মার মানস থেকে সৃষ্ট কৈলাশের মানস সরোবর থেকে নিঃসৃত। তাই এই নদীর  নাম সরযূ। সেই নদী এখানে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই দুই নদীর মিলনের ফলেই দুই বিপরীতমুখী জলধারার সঙ্গমের ফলেএই প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে। রাম, তুমি মনঃসংযম করে এই সঙ্গমে প্রণাম কর।"
     শ্রীরাম লক্ষ্মণ ওই দুই নদীকে প্রণাম করে ঋষির সঙ্গে এলেন দক্ষিণ তীরে। শ্রীরাম দেখলেন - এখান  থেকে পথ গেছে এক শ্বাপদসংকুল ঘোর অরণ্যের দিকে। বনের মধ্য থেকে বন্য প্রাণী, পাখি এবং কীটপতঙ্গের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। সেখানে কোন মানুষের বসতি আছে বলে মনে হচ্ছিল না।
    এই ঘোর অরণ্যের দিকে চেয়ে শ্রীরামকে বিশ্বামিত্র বললেন, "এই অরণ্য অতীতে ছিল এক বিরাট জনপদ। বৃত্রাসুরকে বধ করার সময় ইন্দ্র মললিপ্ত, ক্ষুধিত ও ব্রহ্মহত্যার পাপে আক্রান্ত হয়েছিলেন। দেবতা ও ঋষিগণ এই স্থানে তাঁকে স্নান করিয়ে তাঁর মল পরিষ্কার করেন এবং নানা সুখাদ্য খাইয়ে তাঁর ক্ষুধা মেটান। এখানে ইন্দ্রের মল ও করুষ (ক্ষুধা) দূর হওয়ায় তাঁর বরে এখানে মলদ ও করুষ নামে দুই সমৃদ্ধ জনপদ স্থাপিত হয়। কিছুকাল পরে তাড়কা এসে এই  দুই জনপদ ধ্বংস করে দেয়।"
    শ্রীরাম জিজ্ঞাসা করেন, "তাড়কা কে?
  বিশ্বামিত্র বলেন, " তাড়কা মূলতঃ ছিল একজন যক্ষী। যক্ষ সুকেতু ব্রহ্মার তপস্যা করে তাড়কাকে কন্যারূপে পায়। ব্রহ্মার বরে তাড়কার মধ্যে সঞ্চারিত হয় সহস্র হাতীর বল। জম্ভুপুত্র সুন্দের সঙ্গে তার বিবাহ হয় এবং সুন্দের ঔরসে সে এক পুত্র লাভ করে। তার নাম মারীচ। সুন্দ অগস্ত্য মুনির হাতে বিনাশপ্রাপ্ত হয়। তখন প্রতিশোধ নিতে তাড়কা ও মারীচ অগস্ত্যকে ভক্ষণ করতে যায়। কিন্তু অগস্ত্যকে ভক্ষণ করার সাধ্য তাদের ছিল না। পরিবর্তে অগস্ত্যর শাপে দুজনেই রাক্ষসযোনি প্রাপ্ত হয়। সেই তাড়কা এই বনে বাস করে। এই বন পেরোতে হলে তাড়কাকে বধ করা ছাড়া গতি নেই।"
    শ্রীরাম কিন্তু তাড়কাকে বধ করতে রাজী ছিলেন না। তাড়কা যে মহিলা। ধর্ম অনুসারে স্ত্রীলোক যে অবধ্য। বিশ্বামিত্র সহজেই রামের মনের কথা পড়ে নিলেন। তাই তিনি বললেন,"তাড়কার মত একজন মহিলাকে হত্যা করার বিষয়ে তোমার বিতৃষ্ণা  পোষণ করা উচিত নয়। তুমি একজন রাজপুত্র। তাই তোমার প্রজাদের স্বার্থে যেটা মঙ্গল সেটা অবশ্যই করতে হবে। একজন রাজার বা রাজপুত্রের জন্য তার নাগরিকদের সুরক্ষা এবং কল্যাণকে সর্বাগ্রে রাখতে হয়। প্রজাদের মঙ্গলের স্বার্থে, একজন রাজার যে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত থাকা উচিত - তা যতই কঠোর বা দৃশ্যত পাপপূর্ণ হোক না কেন! এটি প্রকৃতপক্ষে রাজ্য শাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল রাজাদের জন্যই নির্ধারিত ধর্ম।  তাই, দ্বিধা না করে এই রাক্ষসীকে বধ কর। এতে অধর্মের নাশ হবে।"
      এই বলে রাম ধনুকে টঙ্কার দিলেন। ওই টঙ্কারের প্রবল শব্দে এই বিজন অরণ্যের জীবজন্তু সব ভয়ে সশব্যস্ত হয় উঠল। নিশাচরী তাড়কা সেই প্রচণ্ড শব্দ শুনে মহাক্রোধে ছুটে এল তাঁদের সামনে। তখন মহাবীর শ্রীরাম সেই  বিকৃতদর্শনা দীর্ঘাঙ্গী নিশাচরীকে লক্ষ্য করে লক্ষ্মণকে বললেন," লক্ষ্মণ! এই যক্ষিণীর আকার দেখ কি ভয়ঙ্কর! একে দেখলে  সকলেরই হৃদয় কম্পিত হতে বাধ্য। তবু এ যে  নারী।সেজন্যেই একে বধ করতে আমার  মন কোনমতেই  সায় দিচ্ছে না। আমি তাই এই মায়াবিনীর নাক কান কেটে একে দূর থেকেই নিবৃত্ত করছি।" ( এর থেকেও বোঝা যায় শ্রীরাম নারীদের প্রতি কিরকম মনোভাব রাখতেন। যিনি তাড়কার মত একজন ভয়ংকর আতঙ্কবাদী রাক্ষসীকে নারী বলে বধ করতে চান না, তিনি কিভাবে নিজের প্রেয়সী স্ত্রী সীতা দেবীকে বিনাদোষে  অগ্নিপরীক্ষা দিতে বলবেন সকলের সামনে? এগুলি যে উত্তর কবিদের মাধ্যমে রামায়ণে পরে আরোপিত হয়েছে তা আমরা এই রামায়ণ পাঠ করতে করতে  বারবার দেখতে পাব।)
       যাহোক, শ্রীরাম যখন লক্ষ্মণকে এই কথা বলছিলেন সেই অবসরে তাড়কা ক্রোধে অধীর হয়ে হাত তুলে তর্জন গর্জন করতে করতে তাঁরই দিকে দ্রুতগতিতে ছুটে আসতে লাগল এবং আকাশে ধুলো ঝড়ের মায়াজাল বিস্তার করে রাজকুমারদের উপর অনবরত বিশাল বিশাল পাথর এবং গাছের গুঁড়ি ছুঁড়তে শুরু করল। তখন শ্রীরাম আর ক্রোধ সংবরণ করিতে পারলেন না। তিনি শরাঘাতে এই রাক্ষসীর শিলাবর্ষণ নিবারণ করে তার হাতদুটি খণ্ড খণ্ড করিয়া কেটে ফেললেন। কিন্তু তাও তাড়কা থামতে রাজি নয়। সে তাঁদের সামনে এসে আস্ফালন করতে লাগিল। এই দেখে ক্রুদ্ধ লক্ষ্মণ তৎক্ষণাৎ তার নাক কান কেটে দিলেন। তবু তাড়কা নানারকম রূপ ধারণ করে প্রচ্ছন্নভাবে রাক্ষসী মায়ায় রাম ও লক্ষ্মণকে বিমোহিত করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগল।
    শ্রীরাম যে তাড়কাকে নারী রূপে দেখে বধ করতে ইতস্তত করছেন তা অনুভব করতে মহর্ষি বিশ্বামিত্রের সময় লাগল না। তিনি কঠোরভাবে শ্রীরামকে বললেন, "রাম! তুমি নারী বলে এই রাক্ষসীকে বিন্দুমাত্র দয়া কোর না। এই যজ্ঞনাশিনী পাপীয়সী ক্রমশই নিজের মায়াবল পরিবর্ধিত করবে। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে এমনিতেই রাক্ষসরা দুর্নিবার হয়ে ওঠে। তাই সূর্য ডোবার আগেই  তুমি তাড়কাকে বধ কর। নাহলে অন্ধকার নামলে সে অপরাজেয় হয়ে উঠবে।"
      বিশ্বামিত্রের এই সাবধানবাণী শুনে শ্রীরাম তাড়কাকে বধ করতে প্রস্তুত হলেন। এদিকে তাড়কা সাংঘাতিকভাবে আহত হয়েও সিংহনাদ করতে করতে ছুটে আসছিল শ্রীরাম লক্ষ্মনের দিকে। শ্রীরাম তখন তাড়কার উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করলেন এক প্রাণঘাতী বাণ। বাণটি পলকের মধ্যে তাড়কার বুক চিরে করল
নিখুঁত লক্ষ্যভেদ। অবশেষে তাড়কা মৃত্যুবরণ করে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। 
       ইন্দ্রসহ দেবতারা এতক্ষণ আকাশে থেকে এই যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছিলেন। তাঁরা তাড়কাকে শ্রীরামের হাতে মৃত্যুবরণ করতে দেখে আনন্দিত হয়ে বিশ্বামিত্রকে বললেন, "ঋষিবর আপনার মঙ্গল হোক। আপনি এখন আপনার স্নেহের নিদর্শনস্বরূপ শ্রীরামের হাতে প্রজাপতি কৃশাশ্বের তপোবলসম্পন্ন অস্ত্রসকল সমর্পণ করুন। রাম আপনার এই দান গ্রহনের জন্যে একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি।" 
    দেবতাদের কথায় সানন্দে রাজি হলেন বিশ্বামিত্র। এমনিতেই শ্রীরামের এই যুদ্ধে বীরত্ব ও দক্ষতা প্রদর্শনের কৃতিত্বে সন্তুষ্ট ছিলেন বিশ্বামিত্র। তাই শ্রীরামকে কিছু দিতে তাঁরও মন চাইছিল। তবে তখন তো রাত হয়ে গেছে। তাই প্রভাতের প্রতীক্ষা ভিন্ন গতি নেই। সেই রাতে তাঁরা এই বিজন বনেই বাস করলেন।
      পরদিন যথাসমযয়ে পূর্বের আকাশে দেখা দিল নতুন সূর্য্য। শ্রীরাম লক্ষ্মণের অযোধ্যা ছাড়ার পর এটি ছিল চতুর্থ দিন।
  সেদিন সকালে বিশ্বামিত্র  মধুরস্বরে শ্রীরামকে বললেন, "রাম, আমি তোমাকে অদ্ভুত শক্তিশালী দিব্যাস্ত্রসমূহ আজ প্রদান করব। এই সমস্ত অস্ত্র হল প্রজাপতি কৃশাম্বের তনয়স্বরূপ। এই সকল অস্ত্রের প্রভাবে তুমি দেব অসুর গন্ধর্ব সকলকেই পরাস্ত করতে পারবে। আমি এবার তোমাকে দিব্য দণ্ডচক, ধর্মচক্র, কালচক্র, বিষ্ণু চক্র, অতি উগ্র ঐন্দ্রচক্র, বজ্র, শৈব শূল, ব্রহ্মশির অস্ত্র, ইষীকাস্ত্র, ব্রাহ্ম অস্ত্র, মৌদকী ও শিখরী নামের দুই গদা, ধর্ম- পাশ, কাল-পাশ, বারুণ-পাশ, শুষ্ক ও আর্দ্র নামের দুই অশনি, পিনাকাস্ত্র, নারায়ণাস্ত্র, শিখর  আগ্নেয়াস্ত্র, মুখ্য বায়বাস্ত্র, হরশির অস্ত্র, ক্রৌঞ্চাস্ত্র, শক্তিদ্বয়, কঙ্কাল, মুষল, কাপাল ও কিঙ্কিণী, বৈদ্যাধর অস্ত্র, নন্দন অসিরত্ন, মোহন  গান্ধর্ব অস্ত্র, প্রস্বাপনাস্ত্র, প্রশমনাস্ত্র, সৌম্যাস্ত্র, বর্ষণাস্ত্র, শোষণাস্ত্র, সন্তাপনাস্ত্র, বিলাপনাস্ত্র, অনঙ্গের প্রিয় মাদনাস্ত্র, মানব গান্ধর্বাস্ত্র ও মোহন পৈশাচাস্ত্র, তামসা, মহাবল সোমনাস্ত্র, দুর্ধর্ষ সম্বর্তাস্ত্র, মৌষলাস্ত্র, সত্যাস্ত্র, মায়াময়াস্ত্র, শত্রুতেজোপকর্ষণ তেজঃপ্রভ নামের সৌরাস্ত্র, সোমাস্ত্র, শিশিরস্ত্র, তাষ্ট্র অস্ত্র, ও শীতশর প্রভৃতি অস্ত্র প্রদান করছি।"
  এরপর বিশ্বামিত্র এই সমস্ত দেবদূর্লভ মন্ত্রাত্মক অস্ত্র শ্রী রামকে প্রদান করবার জন্য পূর্বমুখী হয়ে ধ্যান করতে লাগলেন। তখন সমস্ত দিব্যাস্ত্রজাল শ্রীরামের সামনে আবির্ভূত হয়ে হৃষ্টচিত্তে জানাল, "রাঘব! আমরা নিজেদের আপনাকে সমর্পণ করলাম। আপনার এখন যেরকম অভিপ্রায়, সেইমত আমরা কাজ করব।*
    শ্রীরাম তখন প্রসন্ন মনে তাঁদের স্পর্শ করে বললেন, "হে দিব্যাস্ত্রগণ! যখন আপনাদের স্মরণ করব তখন আপনারা আমার কাছে উপস্থিত হবেন।" শ্রীরাম অস্ত্রদের এই বলে প্রতিমানসে বিশ্বামিত্রকে প্রণাম জানালেন।
   তারপর বিশ্বামিত্র  শ্রীরামকে প্রতিটি অস্ত্রের প্রয়োগ ও সংহারমন্ত্র শিখিয়ে দিলেন যার মাধ্যমে বিমুক্ত অস্ত্র আবার ফিরিয়ে আনা যায়। এইভাবে শ্রীরামকে নানা দৈব অস্ত্রে বলীয়ান করে বিশ্বামিত্র তাঁদের নিয়ে যাত্রা করলেন তাঁর সিদ্ধাশ্রমের দিকে। 
     সিদ্ধাশ্রমের পথে যেতে যেতে সহসা শ্রীরামের চোখে পড়ল দূরে পর্বতের কোলে একটি মেঘের মত সুদৃশ্য তপোবন। হাঁটতে হাঁটতেই শ্রীরাম বিশ্বামিত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, "ওই পর্বতের গায়ে যে তপোবন দেখা যাচ্ছে ওখানে কার আশ্রম রয়েছে?"
  বিশ্বামিত্র বললেন, "ওইখানে বিষ্ণু বামন অবতারে তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তাই ওখানকার  নাম সিদ্ধাশ্রম। একবার বিরোচনপুত্র বলি ইন্দ্রাদি দেবগণকে যুদ্ধে হারাবার পর  একটি যজ্ঞের আয়োজন করেন। তখন দেবতারা  বিষ্ণুকে বললেন, 'দানবরাজ বলির যজ্ঞে যাচকরা যা প্রার্থনা করছেন তাই পাচ্ছেন। আপনি বামনরূপে  সেখানে যান এবং দেবতাদের হিতার্থে বলির থেকে ইপ্সিত দান নিয়ে তার আধিপত্য খর্ব করুন।'
   যখন দেবতারা বিষ্ণুকে বামনরূপে অবতীর্ণ হতে অনুরোধ করেন, সেই সময়ে  ভগবান্ কাশ্যপ তাঁর স্ত্রী দেবী অদিতির সাথে দিব্য হাজার বছর ধরে একটি ব্রত পালন করছিলেন। ব্রত শেষে ভগবান বিষ্ণু যখন তাঁকে দর্শন দিলেন তখন তিনি বর চাইলেন", হে দেব! আপনি স্বয়ং তপোমূর্তি ও জ্ঞান স্বরূপ অনাদি ও অনন্ত। ভগবন! আমাদের প্রার্থনা , আপনি অদিতির গর্ভে আমার পুত্ররূপে আবির্ভূত হোন।"
   অতঃপর বিষ্ণু দেবী অদিতির গর্ভে বামনরূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং তারপর যথাসময়ে বামন রূপ ধরে দানবরাজ বলির কাছে উপস্থিত হন। বলি তাঁকে দান যাচনা করতে অনুরোধ করেন। তখন বামনদেব  ত্রিপাদ ভূমি ভিক্ষা চান বলির কাছে এবং লোক হিতার্থে দুই পায়ে ত্রিলোক অধিকার করে নেন এবং তৃতীয় পা বলির মাথায় স্থাপন করে তাঁকে নিজের বশে নিয়ে আসেন। এইভাবে বামন বলিকে বন্ধন করে দেবতাদের ফিরিয়ে দেন ত্রিলোক। সেই বামনদেব আগে এই শ্রমনাশন আশ্রমে বাস করতেন। এখন আমি তাঁরই প্রতি ভক্তিপরায়ণ হয়ে এই আশ্রমে আছি।  নিশাচর রাক্ষসরা এখানে এসেই আমার যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটিয়ে  থাকে। এখানেই তোমাদের সেই দুরাচারীদের বিনাশ করতে হবে। আজি আমরা সেই সর্বোৎকৃষ্ট সিদ্ধাশ্রমে পৌঁছব।"
   সেদিন সন্ধ্যায় তাঁরা সিদ্ধাশ্রমে পৌঁছলেন। সেখানে পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর  শ্রীরাম এবং লক্ষ্মণ সবিনয়ে বিশ্বামিত্রকে জানান যে তিনি এবার যজ্ঞর জন্যে প্রস্তুত হতে পারেন কারণ তাঁরা দুই ভাই এবার যজ্ঞভূমি পাহারা দেয়ার জন্যে প্রস্তুত। 
    যথাসময় বিশ্বামিত্র যজ্ঞের সূচনা করেছিলেন।  যজ্ঞে বসতে হলে ঋষিদের কিছু আচার বিচার অনুসরণ করতে হয়। তার মধ্যে একটি হল মৌন ব্রত। অর্থাৎ আসন্ন যজ্ঞে বসার পর ছয় দিন ও রাত্রি, বিশ্বামিত্র একটি শব্দও বলবেন না। শুধুমাত্র যজ্ঞের দিকেই  থাকবে তাঁর মনোনিবেশ। আর এই জন্যেই তাঁর নিজের যজ্ঞে বিঘ্নকারী অসুরদের শাস্তি দেয়া সম্ভবপর ছিল না। তাই শ্রীরাম এবং লক্ষ্মণকে এই যজ্ঞ রক্ষা করার জন্যে সুদূর অযোধ্যা থেকে নিয়ে আসতে হয়েছিল তাঁকে।
    যথাসময়ে শুরু হল যজ্ঞ। এরপর পাঁচ দিন রাত বেশ শান্তিতেই কাটল কোন উপদ্রব ছাড়া। কিন্তু ষষ্ঠ দিন  ভোরে যখন বিশ্বামিত্রের বৈদিক মন্ত্রের উচ্চারণে আকাশ  বাতাস ভরে উঠল, শ্রীরামের মনে হল - এবার বিপদ আসন্ন। শ্রীরাম লক্ষ্মণকে তৎক্ষণাৎ বললেন,"এবারই সুবাহু এবং মারীচ যজ্ঞ পণ্ড করতে  আসবে মনে হচ্ছে। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে আরো।" শ্রীরাম যখন এই কথা বলছিলেন, তখনই সহসা আকাশে বজ্রপাতের মত একটি প্রচণ্ড শব্দ প্রতিধ্বনিত হল। শ্রীরাম তৎক্ষণাৎ মাথা তুলে দেখতে পেলেন -  দুই রাক্ষস সুবাহু এবং মারীচ তাদের দলবল নিয়ে আশ্রমের দিকে আকাশপথে ছুটে আসছে। আর আকাশ থেকে তারা চারিদিকে রক্তের স্রোত ছড়িয়ে দিচ্ছে। বলেই বাহুল্য যে যজ্ঞ অপবিত্র করাই তাদের লক্ষ্য।
  শ্রীরাম সেদিকে চেয়ে লক্ষ্মণকে বললেন, "লক্ষ্মণ!  আমি এই সাধারণ অল্পপ্রাণ রাক্ষসদের বিনাশ করতে চাই না। বরং মানবাস্ত্র দিয়ে বায়ুবেগে মেঘের মত এই সমস্ত দুরাচারী মাংসাশী প্রাণীদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছি।"  এই বলে তিনি ধনুকে তেজদীপ্ত মানবাস্ত্র যোজনা করে মারীচের উপর নিক্ষেপ করলেন। মারীচ সেই মানবাস্ত্রর আঘাতে আহত হয়ে শত যোজন দূরে মহাসাগরে গিয়ে পড়ল।  কিন্তু তবু রাক্ষসরা আক্রমণ বন্ধ করল না।  তাই এবার শ্রীরাম অবিলম্বে ধনুকে কার্মুক আগ্নেয়াস্ত্র সন্ধান করে  সুবাহুর বুকের উপর তা নিক্ষেপ করলেন। সুবাহু সেই  আগ্নেয়াস্ত্রর আঘাতে তৎক্ষণাৎ মাটিতে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করল। এরপর  শ্রীরাম বায়বাস্ত্র ব্যবহার করে অবশিষ্ট রাক্ষসদের বধ করলেন।
     এইভাবে রাক্ষসদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে শ্রীরাম যজ্ঞ রক্ষা করলেন। এতে আশ্রমের মহর্ষিদের আনন্দের আর পরিসীমা রহিল না। তাঁরা দেবাসুর সংগ্রামে বিজয়ী ইন্দ্রের মতই শ্রীরামের সমাদর করতে লাগলেন। 
  অবশেষে যথাসময়ে মহর্ষি বিশ্বামিত্র নির্বিঘ্নে যজ্ঞ শেষ করলেন এবং যজ্ঞস্থল  নিষ্কণ্টক দেখে সানন্দে শ্রীরামকে বললেন, "বৎস! আমি সত্যিই কৃতার্থ হলাম। তুমি তোমার কর্তব্য যথার্থই পালন করেছ - আমাদের যজ্ঞ রক্ষা করেছ এই দুরাচারী রাক্ষসদের থেকে।"  
  বিশ্বামিত্র এইভাবে শ্রীরামের  প্রশংসা করে তাঁকে এবং লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে এবার সন্ধ্যা উপাসনা করবার জন্য প্রস্তুত হলেন।
      (ক্রমশ)

#বাল্মীকি #রামায়ণ #শ্রীরামচন্দ্র #balmiki #ramayana #rama #tarashisgangopadhyay #tarashisauthor #devotional #spiritual #epic

5 comments:

  1. Excellent. - Arnab Mallick

    ReplyDelete
  2. অপূর্ব ❤️🙏

    ReplyDelete
  3. Khub valo laglo porte

    ReplyDelete
  4. Khub valo lagche

    ReplyDelete
  5. আবার নতুন করে রামায়ণ পড়তে ও জানতে খুব ভালো লাগছে দাদা, অনেক ধন্যবাদ ও প্রনাম আপনাকে এমন সুযোগ করে দেওয়ার জন্য 🙏

    ReplyDelete