দেবলোকের স্মৃতি
আজকে আমার "দেবলোকের অমৃতসন্ধানে" গ্রন্থের "বাসুকিতাল-কালিন্দী খাল -পঞ্চবদ্রী পর্ব" পুনর্মুদ্রিত হয়ে আশ্রমে এলো। এই পর্বটির তৃতীয় সংস্করণ এটি।
কোথায় যেন পড়েছিলাম শিবরাম চক্রবর্তীর লেখায় - বই মুদ্রিত হওয়া মানে সন্তান হওয়া আর পুনর্মুদ্রিত হওয়া মানে নাতি হওয়া। সেই অনুসারে আমার তো নাতিতেই ঘর ভর্তি এখন।
আজ মনে পড়ছে - হিমালয়ে কাটিয়ে আসা সেই দিনগুলোর কথা যার উপর ভিত্তি করে লিখেছি আমার এই ৪ খন্ডে সমাপ্ত ভ্রমনকাহিনী। কি ভয়ঙ্কর সুন্দর ছিল সেই পথ।নির্জন,নিরিবিলি,আকাশে বাতাসে শান্তির অনুরণন। মাঝে মাঝে সাধুসন্তদের সাক্ষাত। আর তার মাঝে পথ চলা। পথে বিপদ আছে।চলায় শ্রান্তি আছে - কিন্তু একটু বিশ্রাম নিলেই হিমালয়ের কৃপায় সব কষ্ট মিলিয়ে যায়।
মনে আছে - হিমালয়ে আমরা যখন গেছিলাম তখন আমাদের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স শুন্য। যা টাকা ছিল ব্যাঙ্কে বাবা সবই তুলে নিয়েছিলেন। ফেরার পর কি খাওয়া দাওয়া হবে তার ঠিক ছিলনা। আয়ের উপায় বলতে একমাত্র বাবার বই বিক্রি।আমার তো তখন সবেধন নীলমণি একটাই বই - মহাসিন্ধুর ওপার থেকে।( দে বুক স্টোরের ম্যানেজার স্বপনদা রসিকতা করে বলতেন -ঐতো তোমাদের বাবা ছেলের পাবলিকেশন। বাবার একটা বই "মহাপীঠ তারাপীঠ", ছেলের একটাই বই "মহাসিন্ধুর ওপার থেকে"; ওই দুটো বই সম্বল। বর্তমানে অবশ্য এত বই বেরিয়ে গেছে যে স্বপনদা এখন বদলেছেন মত -দেখা হলে বলেন"আর কি নতুন বই আসছে আপনাদের?"সময়ের সাথে সাথে তুমিটা আপনি হয়েছে।)
তবে ব্যাঙ্কের ভাঁড়ার শেষ করে হিমালয় ভ্রমণে গেলেও প্রানভরে ভ্রমণ করেছিলাম আমরা।আর সেইসময়েই ঠিক করেছিলাম - হিমালয়ের উপর একটি ভ্রমণ কাহিনী লিখব। ইতিপূর্বে তো অনেক লেখক হিমালয় নিয়ে লিখেছেন।আমিও লিখব আমার নিজস্ব স্টাইল-এ। আমার পরিকল্পনা ছিল - ভ্রমণ কাহিনীটা হবে ভিডিও ফিল্মের মত আর সেই ভিডিও ফিল্ম আমি শব্দ দিয়ে গড়ব। সেইমত ছোট একটি ডায়েরি নিয়ে পথে নামতাম।যেখানে যা দৃশ্য দেখতাম তার বিবরণ খাতায় তুলে নিতাম। সেসময়ে আমার নিজের ক্যামেরাও ছিলনা। রথিনদা তথা মন্টুদার ক্যামেরা ধার নিয়ে ৫ রীল ফিল্ম ছবি তুলেছিলাম। তাই যেখানে মন্টুদা ছিলেন সেখানে আমার ছবি উঠেছে।যেখানে তিনি নেই সেখানে আমার ছবিও নেই।
তারপর শুরু হলো হিমালয়ের লীলা।কত মহাত্মাদের সেবার দর্শন করেছি।নাগাজীর মত মহাত্মা তো কোটিতে গোটিক মেলে। তাঁর স্নেহছায়ায় পথ চলার সৌভাগ্যও লাভ করেছি। হিমালয়ের বিজন অঙ্গনে কত উচ্চকোটির সাধক আমায় কৃপা করেছেন।তাঁদের জন্যেই আমার হিমালয় ভ্রমণ স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। আজ তাঁদের কৃপায় লেখা "দেবলোকের অমৃতসন্ধানে" গ্রন্থের সুনাম দিকে দিকে। তবে সেইসময়ে হিমালয়কে আমি যেভাবে দেখেছিলাম আর তার সেই রূপসুধা পান করার উপায় এখন নেই।যন্ত্রসভ্যতার বীজ এখন সেখানেও জেগে উঠেছে।তাই হিমালয়ের সেই প্রশান্তি এখন দিনেরাতে তেমনভাবে উপভোগ করা যায়না। আমার সৌভাগ্য - প্রমোদ কুমার চট্টোপাধ্যায় ,প্রবোধ সান্যাল,জলধর সেন,উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়,শঙ্কু মহারাজ হিমালয়ের যে রূপসুধা পান করতে পেরেছিলেন আমি ছিলাম সেই মহান হিমালয় প্রেমিকদের শেষ উত্তরসুরী - Last of the Mohicans যার হিমালয় ভ্রমণ পর্যন্ত হিমালয়ের সেই নিরবছিন্ন শান্তির অমৃত পান করা যেত। বর্তমানে যন্ত্রসভ্যতার আক্রমনে হিমালয় জর্জরিত। তবু আজো হিমালয়কে ভালোবেসে তার কাছে গেলে হিমালয় কৃপা করেন। শুধুমাত্র ব্রাহ্মমুহুর্তে এখন হিমালয়কে নিজের রূপে পাওয়া যায় যা অন্যসময়ে যায়না।
আমার "দেবলোকের অমৃতসন্ধানে" গ্রন্থের আমার সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলির স্মৃতি বড় ভিড় করে আসছে মনে। সেদিন আমি কিছুই ছিলামনা। আজ যেটুকু হতে পেরেছি সবই হিমালয়ের দয়া,গোপালের দয়া আর মা তারার দয়া। তাই ফেলে আসা দিনগুলি বরাবরই আমার প্রেরণা রূপে দেখা দেয়। শুন্য থেকে শুরু করে আজকের দিনে আসার এই পথটুকু যে ইষ্টকৃপার জন্যেই সম্ভব হয়েছে।
No comments:
Post a Comment